পেশা আর দায়িত্বের সাথে মানবিকের তালগোল


মানবিক, যা বাংলা চারটি বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত একটা শব্দ। এই মানবিক শব্দের অনেক অর্থ আছে। আমরা কমবেশি সবাই জানি মানবিক মানেই মানবতা, দয়াবান, দয়ালু, পরোপকারী, নিঃস্বার্থভাবে আর্ত মানবতার সেবায় যিনি কাজ করেন, যিনি নিজের সময় শ্রম মেধা পকেটের টাকা খরচ করে অন্যের কল্যাণে কাজ করেন, যিনি কোনো বিনিময় চাননা, কোনো প্রতিদান চাননা, যার কাজের কোনো জবাবদিহিতা নেই বাধ্যবাধকতা নেই তবুও তিনি করেন, যার মধ্য মানবিক গুণাবলি রয়েছে তাকেই মানবিক বলে। এই শব্দটা কেবল একজন ব্যক্তি এবং ব্যক্তির নামের আগে পিছেই ব্যবহার হওয়া উচিৎ।
আমরা জানার পরেও শব্দটাকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করছি, যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ব্যবহার করছি। কেউ না জেনে করছি আবার কেউ নিজেদের বিশেষ একটা স্বার্থ হাসিলের জন্য জেনে-বুঝে করছি। কেউ করছি ভুল তো কেউ করছি অন্যায়। ভুল কেন বললাম? কারণ, না জেনে মনের অজান্তে অনিচ্ছাকৃতভাবে করছি এজন্যই ভুল। আর অন্যায় কেন? কারণ, সবকিছু জানা সত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সঠিকটাকে বেঠিকভাবে উপস্থাপন করে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছি, যা একধরনের অন্যায়।
আমরা প্রত্যেকেই দৈনন্দিন জীবনে কর্মক্ষেত্রে চলাফেরায় হরহামেশাই ভুল করি। যা কখনো জানতেও চেষ্টা করিনা, আবার মানতেও চাইনা। প্রকৃতপক্ষে আমরা আসলে জানিইনা কোনটা ভুল আর কোনটা অন্যায়। ভুল হলে তো ভুলই আবার অন্যায়টাকেও ভুলের বাক্সে বন্দী করে রাখি। মানে গড় এভারেজে সবকিছুকেই ভুলের সারিতে দাড় করিয়ে দেই। একটা সময় কেউ ভুল স্বীকার করি আবার কেউ কেউ আত্মসম্মান আর আত্ম-অহমিকার দাম্ভিকতায় বুক ফুলিয়ে চলি। আমাদের বুঝা উচিৎ ভুল কখনো অন্যায় হয়না, আবার অন্যায় কখনো ভুল হয়না। ভুল শোধরানো যায় কিন্তু অন্যায়?
ভুল তো সেটাই যা আমি/আমরা জানিনা, না জেনেই মনের অজান্তে করে ফেলি যা সঠিক নয়। এই-যে না জেনে সঠিকটাকে বেঠিকভাবে উপস্থাপন করা এটা হচ্ছে অনিচ্ছাকৃত, মানে ভুল। যদি জানা থাকতো তাহলে ভুল হতো না। আর অন্যায় সেটাই যা জানি অথচ জানার পরেও নিজের ইচ্ছেমতো উল্টোভাবে উপস্থাপন করি। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তির নাম করিম, এলাকার সবাই ওই ব্যক্তিকে করিম নামে চেনে। এখন গ্রামের কোনো এক লোক সে নিজে জানেনা ওই ব্যক্তির নাম আসলে কি, সে কারো কাছ থেকে জানতে পারলো ওই ব্যক্তির নাম কালা মিয়া। এখন যদি সে ওই করিমকে কালা মিয়া নাম ধরে ডাকে তাহলে কিন্তু এটা অন্যায় নয়, বরং সে ভুল করেছে। যদি জানতো তাহলে নিশ্চই করিম নাম ধরেই ডাকতো। একই গ্রামের অন্য এক লোক যিনি করিমকে করিম নামেই চিনে কিন্তু তারপরেও সে করিমকে কালা মিয়া নাম ধরে ডাকে। এই যে জেনে-বুঝেও করিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য নামে ডাকছে এটা নিঃসন্দেহে সে অন্যায় করছে। একটা হচ্ছে অনিচ্ছাকৃত, আরেকটা ইচ্ছাকৃত। অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়, কিন্তু জেনেশুনে বুঝে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে উল্টো করে তাহলে সেটা অবশ্যই অন্যায়।
আর এই ভুল বা অন্যায়টা দিনের পর দিন প্রতিনিয়ত অহরহ হচ্ছে মানবিক শব্দটার সাথে। একজন লোক যদি চুক্তিভিত্তিক অথবা বেতনের বিনিময়ে কোনো পেশায় নিয়োজিত থাকে তাহলে ওই পেশার ভেতরে থেকে যতগুলো কাজ সে করবে এই কাজের জন্য তাকে কখনোই মানবিক বলা যাবেনা। একজন সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী এবং একজন জনপ্রতিনিধি ( ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য পর্যন্ত) পেশায় থেকে যেই দায়িত্ব পালন করেন সেই দায়িত্ব পালনের জন্য কখনো তাকে মানবিক বলা যেতে পারেনা। কারণ হচ্ছে উনাদেরকে ওইসব স্থানে বসানো হয়েছে বা নিয়োগ দেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য। প্রত্যেকেই স্ব স্ব পেশায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বেতন ভিত্তিক নিয়োজিত হয়েছেন যেন উনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন। নিয়োগকৃত পেশা, নির্বাচিত পেশা, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, জনগণের ভোটে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য থেকে সংসদ সদস্য, এরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব পেশায় বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত। প্রত্যেকের কাজের/দায়িত্বের দায়বদ্ধতা আছে, বাধ্যবাধকতা আছে, জবাবদিহিতা আছে। কেউ যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে এরজন্য কারন দর্শাতে হবে। এক কথায় যাকে যেই কাজে/দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেই কাজ/দায়িত্ব পালনে সে বাধ্য। যেই পেশায় বাধ্যবাধকতা আছে, যেই পেশায় জবাবদিহিতা আছে, যে পেশায় দায়বদ্ধতা আছে সেইসব পেশার সাথে মানবিক শব্দটা বড়ই বেমানান। এটা জেনেও যারা এই শব্দের অপব্যবহার করছেন নিঃসন্দেহে তারা অন্যায় করছেন, অপরাধ করছেন। প্রায় সময় দেখি বলা হয় অমুক মানবিক মেম্বার, মানবিক চেয়ারম্যান, মানবিক ওসি, মানবিক এসিল্যান্ড, মানবিক ইউএনও, মানবিক ডিসি, মানবিক ডাক্তার, মানবিক এমপি, মানবিক মন্ত্রী, কিন্তু কেন? উনাদের এই পেশার সাথে তো কিছুতেই মানবিক শব্দটা যায়না। এসব পেশায় থেকে যদি কেউ সঠিক ও সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করে তাহলে তাকে একজন দায়িত্বশীল বলা যেতে পারে, কর্মট বলা যেতে পারে। তাই বলে মানবিক ট্যাগ দেয়াটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? উদাহরণস্বরূপ, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি, উনার কাছে ১০০-৫০০ রিলিফ/ভিজিএফ কার্ড এসেছে গরীব ও অসহায়দের মাঝে বিতরণের জন্য। উক্ত প্রতিনিধি কি করলো নিজ দায়িত্বে দেখেশুনে প্রকৃত অসহায় গরীবদের মাঝে কার্ডগুলো বিতরণ করলেন। এখন এই প্রতিনিধি যা করেছেন এটা শুধুমাত্র উনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
একটা থানায় জিডি করতে গেলে কোনো টাকা পয়সা দিতে হয়না এটাই নিয়ম, অথচ দিনের পর দিন চলে আসছে তার উল্টো। হঠাৎ ওই থানায় কোনো এক ওসি বদলী হয়ে এসে সাথে সাথেই ঘোষণা দিলেন যে, আজকে থেকে এই থানায় জিডি করতে আসলে কোনো টাকা পয়সা লাগবেনা, কোনো টাকা দিতে হবেনা। ওসি সাহেব এই-যে কাজটা করেছেন এটাই ছিলো উনার দায়িত্ব। উনি শুধুমাত্র উনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) যিনি পুরো উপজেলার দায়িত্বভার নিয়ে বসে আছেন, উনার কাছে সরকার থেকে ৫০টা ঘর আসলো সুবিধাবঞ্চিত/বাস্তহারাদেরকে দেয়ার জন্য। ইউএনও সাহেব নিজ দায়িত্বে দেখেশুনে পর্যবেক্ষণ করে প্রকৃত ৫০টা সুবিধাবঞ্চিত/বাস্তহারা পরিবারেকে উক্ত ঘরগুলো দান করলেন। এই-যে কাজটা করেছেন এটা ছিলো ইউএনও সাহেবের দায়িত্ব।
জনপ্রতিনিধি, ওসি এবং ইউএনও এই-যে কাজগুলো করেছেন, এগুলো উনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কেউ করেনি, নিজের শ্রম ও ব্যক্তিগত সময় ব্যয় করে নিঃস্বার্থভাবে কেউ করেনি। এই কাজ করতে উনারা বাধ্য, চুক্তিবদ্ধ, উনারা পেশার ভেতরে বন্দী। এরজন্য যদি উনাদেরকে মানবিক বলা হয় তাহলে এটা ভুল এবং অন্যায়। শুধুমাত্র ৩ জনকে দিয়ে দেখালাম, বাকি প্রতিটা দপ্তরে, প্রতিটা সেক্টরে, একজন কর্মচারী থেকে রাষ্ট্রের একজন সর্বোচ্চ কর্মকর্তা সহ প্রত্যেকেই যার যার পেশায় বেতনের বিনিময়ে নিয়োজিত আছেন কেউ-ই মানবিক নয় যদি শুধুমাত্র তার দায়িত্ব পালন করেন। যখন সঠিক সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন তাহলে অবশ্যই দায়িত্বশীল, কর্মট, নীতিবান বলা যায়।
শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন করে যদি উনারা মানবিক হয়ে যান তাহলে নিঃস্বার্থভাবে নিজের পকেটের অর্থ শ্রম মেধা সময় ব্যয় করে যারা আর্ত-মানবতার সেবায় কাজ করেন তাদেরকে কি বলে? মানবিক শব্দটা কেবল তাদের সাথেই শোভা পায় যাদের কোনো স্বার্থ নেই, যাদেরকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি অথচ তবুও নিজ কর্তব্যে করে থাকে, যারা নিজেদের সাংসারিক পারিবারিক সকল কর্মব্যস্ততার পরেও অন্যের কল্যাণে কাজ করেন, যারা কোনো বিনিময় চায়না প্রতিদান চায়না, যাদের কাজের কোনো জবাবদিহিতা নেই বাধ্যবাধকতা নেই দায়বদ্ধতা নেই অথচ তবুও মনের আনন্দে কাজ করে মানুষের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনেন। এরাই হচ্ছে প্রকৃত মানবিক। আবার কেউ পেশায় থেকে দায়িত্বের বাইরে কল্যাণমূলক কাজ করলে তখন তাকে অবশ্যই মানবিক বলা যায় এবং তখন মানবিক শব্দের পূর্ণতা পায়।
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে এই শব্দের সঠিক প্রয়োগ না হয়ে যার তার আগে পিছে যেখানে সেখানে মানবিক ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা কেউ না জেনে করছে, আবার কেউ জেনে-বুঝে করছে নিজের বিশেষ সুবিধা ও স্বার্থ হাসিলের জন্য। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় এই শব্দটা শুধু ইতিহাস হয়ে থাকবে। আর যারা এর যোগ্য না ওরা এই শব্দের প্রকৃত দাবিদার ও মালিক বনে যাবে এবং যারা নিজেদেরকে উজার করে দিয়ে মানবকল্যানে কাজ করে তারা হবে বঞ্চিত, অবহেলিত।
যারা লেখালেখি করেন, সাংবাদিকতা করেন প্রত্যেকের উচিৎ এই শব্দের সঠিক ব্যবহার করা। সকল সুবিধা ও স্বার্থ ত্যাগ দিয়ে মানবিক শব্দের প্রতি সুবিচার করা। সঠিক শব্দটাকে যথাযথ ও সঠিকভাবে উপস্থাপন করলে তবেই এর পূর্ণতা পাবে, জাতি বিভ্রান্তিমুক্ত হবে। আমাদেরকে মনে রাখা উচিৎ পেশা আর দায়িত্বের সাথে মানবিক শব্দটা কিছুতেই যুক্ত হতে পারেনা এবং হয়না। আমাদের সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
এস এম মিজানুর রহমান মামুন
লেখক ও কলামিস্ট