বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ে দখল উৎসব


একদিন যে নদীকে ঘিরে ঢাকা মহানগরী গড়ে উঠেছিল সেই নদী এখন মানুষের সময়ের সাথে সাথে এই বুড়িগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়। নদীর দুই কূল ঘেঁষে অবৈধভাবে দখলের কারণে বুড়িগঙ্গা নদী ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে।বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী বুড়িগঙ্গা। চারশো বছর আগে এই নদী তীরেই গড়ে উঠেছিল ঢাকা।
বুড়িগঙ্গার পাড়ে যেয়ে দেখা গেলো নদীর পাড়ে সারি সারি নৌকা । নদী পারাপারের জন্য বহু মাঝি ঘাটে বসে অপেক্ষা করছে খেয়া পারাপারের জন্য । ছোটবেলায় এই নদীতে সাঁতার কেটে বড় হয়েছেন এমন অনেকেই ছাড়তে পারেনি এই নদীকে। তাই পেশা হিসেবে এই নদীতেই নৌকা চালিয়ে আয় করেন অনেক মাঝি।
জাকির হোসেন পেশায় মাঝি, বায়ান্ন বছর ধরে বাস করেন বুড়িগঙ্গার পাড়ে। বলছিলেন ছোটবেলার কথা, “ছোটকালে নদীর চেহারা অন্যরকম ছিল। নদী বহুত বড় ছিল। মাছ মারছি,মাছ মাইরা বাইত নিয়া খাওয়া দাওয়া আরম্ভ কইরা দিসি”। দিন দিন চোখের সামনে দেখেছেন নদীর দখল হওয়া কিছুটা চাপা ক্ষোভ নিয়ে বলছিলেন সেই কথা। “পঁচিশ ছাব্বিশ বছর ধইরা মনে করেন নদীর দুই পাড় দখল হওয়া দেখতেসি। তারপর যে কি হবে কেউ বলতেই পারবেনা। এগুলো তো সরকারই কেয়ার করে না তাইলে আর মানুষে কেয়ার কইরা কি করব। আপনে প্রতিবাদ করতে গেলে আপনিই মাইর খাবেন তাইলে আর প্রতিবাদ করব কেঠা?’’
রাজধানীর পোস্তগোলা আর শ্যমপুর এলাকার ঘুরে দেখা গেলো বুড়িগঙ্গার দু’পাড়ে দখলদাররা বিভিন্ন কায়দায় বিশাল এলাকা দখল করে গড়ে তুলছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সদর ঘাট পেরিয়ে পোস্তগোলা এলাকায় যেয়ে দেখলাম নদীর পাড়ে ইট রাখা হয়েছে স্তুপ করে ।এই চিত্র এখন নদীর ঘাটে খুব সাধারন দৃশ্য । পোস্তগোলার শ্মশানঘাট এলাকায় যেয়ে দেখা গেলো নদীতে ড্রেজার লাগিয়ে বালু তোলা হচ্ছে এবং বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে বালু রেখে জায়গাটা দখল করে সেখানে বালু বেচা কেনা চলছে।
এই বালু দেখাশুনার দায়িত্বে আছেন এমন একজনের কাছে জানা গেলো এখানে বালু বেচা কেনা হয় চার পাঁচ বছর ধরে। রাতে বেচাকেনা হয় এই বালু ।আরও জানা গেলো তার মালিকের এরকম বালুর গদি শ্মশানঘাট এলাকায় আরও চারটা আছে আর শ্যমপুরে আছে মোট সাতটা গদি ।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ করে পিলার বসানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে এই সিমানা পুনরুদ্ধার করার পর সেটা যেন আর দখল না হয় সেজন্য ওয়াকয়ে অথবা সবুজায়ন করা। কিন্তু এসব রায় হলেও কাগজেই রয়ে গেছে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।শ্যামপুরের ইকোপার্কে ঢুকে বুড়িগঙ্গার তীরে দাড়িয়ে ঠিক নদীর ওপারে দেখা গেলো সিমেন্টের তৈরি ছোট ছোট পিলার যা কিনা বুড়িগঙ্গার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে কিছু পিলার ভেঙ্গে গেছে কিছু পিলার হেলে পরেছে।
এইসব সীমানা পিলার এর অস্তিত্ত্ব কিছু জানান দিচ্ছে না বুঝা গেল পিলার উপেক্ষা করে বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ে দখলের উৎসব দেখে। এই সীমানা পিলার থাকার পরেও বুড়িগঙ্গা জমি অবৈধ ভাবে দখল করছে ।এই বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলোনের যুগ্ন সম্পাদক শরীফ জামিল মনে করেন সরকার যদি নদী রক্ষায় আন্তরিক থেকে থাকে তাহলে শুরুতেই নদী দখল হবে না ।
তিনি বলেন, “আমাদের কিছু ভ্রান্ত নীতি আছে। যেমন আমরা সরকারী প্রতিষ্ঠান নদীর মধ্যে করি ।আমরা ব্রিজ গুলি যখন করি তখন স্বল্প দৈর্ঘ্য ব্রিজ করি। তারপর দখলদার হয় বড় বড় প্রভাবশালী যারা। আর উচ্ছেদের প্রক্রিয়ায় দেখা যায় ছোটো ফলের দোকান,সব্জি ব্যবসায়ী ওদের উচ্ছেদ করা হয় দ্রুততার সাথে।কিন্তু কোন বড় ফ্যক্টোরি বা বড় দখলদার আজ পর্যন্ত উচ্ছেদের কোন নজীর আমরা দেখিনি। এবং দখল প্রতিদিন দখল অব্যাহত আছে। একটা বড় ক্ষমতাশালী চক্র এটা করছে”।
হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য এবং বিআইডব্লিউটি এর সীমানা প্রাচীরকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বুড়িগঙ্গার বুক চিরে আবারো দখলের রাজত্ব কায়েম হয়েছে।উচ্ছেদের পরও কেন বুড়িগঙ্গার জমি আবার দখল হচ্ছে। দখল হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ‘বিআইডব্লিওটিএ’এর ‘পোর্ট এন্ড ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর শফিকুল হক বলছেন সীমানা পিলার এর বাইরের জায়গাটা পাবলিক ল্যন্ড ফলে কেউ কেউ সেখানে স্থাপনাদি করলেও পোর্ট লিমিট আছে ।
তিনি বলেন, “আমাদের যে পোর্ট লিমিট আছে নদীর সিমানার পরেও ১৫০ ফিট সে জায়গাটাকে কোন কিছু ডেভেলপ করতে হলে ‘বিআইডব্লিওটিএ’এর পারমিশন নিয়ে করতে হয় যদি কেউ এই ধরনের ব্যবসা করে আমরা তাদের উচ্ছেদের মাধ্যমে উঠিয়ে দেই”।
ব্রহ্মপুত্র আর শিতালক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে বুড়িগঙ্গা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল । তবে বর্তমানে এটা ধলেশ্বরীর শাখা বিশেষ । মূলত ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। কলাতিয়া এর উৎপত্তিস্থল। বর্তমানে উৎসমুখটি ভরাট হওয়ায় পুরানো কোন চিহ্ন খোঁজে পাওয়া যায় না। পরবর্তিতে যদি কেউ না শুনে তাদেরকে আইনের আশ্রয় নিয়ে শাস্তি দেয়া হয় এমনকি ফৌজদারি মামলা করে থাকি। ”
বুড়িগঙ্গার পাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা সত্তর বছর বয়সী মোঃ শহিদ হাহাকার করে উঠেন তিনি বলেন- আগে নদী বড় ছিল মানুষের মন ও বড় ছিলো কিন্তু এখন নদীও গেছে মানুষ ও গেছে। নদীর পাড়ে যারা বড় হয়েছেন এবং জীবন ধারন করেন তারা মনে করেন বুড়িগঙ্গা বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে ।