“সাকসেসফুল” বিষয়টার ব্যতিক্রম ব্যাখ্যা-মারুনা রাহী রিমি


একটা সময় অবধি জীবনের হাজারো নেগেটিভিটি আমাকে অনেক বেশি নেগেটিভ ভাবাতো, নেগেটিভ বানিয়েও ফেলেছিলো। মিথ্যা সহ্য হতো না, অন্যায় গিলতে পারতাম না, অপরাধ হজম হতো না।
দোষ না করেও দোষী, ভুল না করেও ভোগী, অন্যায় না করেও শাস্তি, অপরাধ না করেও সাজা পাওয়া আমার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়িঁয়েছিলো যেগুলো আমাকে মানসিকভাবে ভেঙে টুকরো করে জীবনের কাছে হারিয়ে দিতো।
একসময় নিজের প্রতি মায়া, ভালবাসা কিছুই ছিলো না৷ নিজেকে ব্যাথা দিতে, রক্তাক্ত করতেও দ্বিধা করতাম না। মনে ভয়-ডর বলে কিছুই ছিলো না। পশম লেগে গাড়ি গেলেও না ভয় পেতাম, না সরে যেতাম।
আব্বুর অসুস্থ হবার আগে অবধি আমার এসব বোঝার বিন্দুও মানসিকতা ছিলো না। মনে হতো, আল্লাহ আমাকে শুধু শুধু বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই পৃথিবীতে আমাকে কারো প্রয়োজন নেই, আমি কোন কাজের নই।
আব্বু অসুস্থ হবার পর বেশ বড় দায়িত্ব এসে পরলো। মনে হতো শ্বাস নেয়ার সময়টাও নেই। তারপর শত নেগেটিভের মাঝেও ধীরে ধীরে উপলব্ধি হতে থাকলো, এই দিনগুলোর জন্যই আজও আমি বেঁচে আছি। কেননা, এই সময় আব্বুর আমাকে খুব প্রয়োজন ছিলো।
আব্বু মারা যাবার পর আম্মুর প্রয়োজন হিসেবে তার সাথে ছায়ার মত ছিলাম। ৪০ দিন উনার সাথে সাথে আমিও বাইরে যাই নি, ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়েছি, নানা ধরনের খতমের পর খতম দিয়েছি, টিভি না, মোবাইল না, কিছুই না। মনে হতো, আব্বুর শোকে আম্মু যদি মানসিক ভাবে সিক হয়ে যায়।
আম্মু সামলে উঠার পর ভাইয়ের বিয়ে, বউ এলো, তাদের প্রথম সন্তান এলো। বাচ্চাটার আমার জন্য নিখাঁদ ভালবাসা মনে হতো, জীবনের জন্য এটাই এনাফ।
নিজেকে এসবের মাঝে আলাদা করে নিতে নিতে বিয়ে নামক অভিশাপ এসে লাগলো। ৩০ বছরে বিয়ে হবে, সবাই মাথাটাই খারাপ করে দিলো যে, এবার বিয়ে না হলে আর সম্ভব নয়। নিজের উপর মানসিক এক প্রকার চাপেই বিয়েটা করে ফেললাম।
এবার এডজাস্ট করতে করতে, মেনে ও মানিয়ে নিতে নিতে মনে হচ্ছিলো, কেউ বুঝি সাগরের মাঝে আমাকে ফেলে চলে গেছে, আমি সাঁতার পারি না, হাবুডুবু খাচ্ছি, মরিও না, বাঁচিও না।
এমন সময় জীবনের জন্য আল্লাহ বিন্দু একটা আলোর ঝলক দেখিয়ে দিলেন যখন গর্ভে এলো নামিরা। জান-জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করে করে তাকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর পরও চলছে একের পর এক যুদ্ধ।
এবার একটা পজিটিভ বিশ্বাস আমাকে নতুন ভাবে বাঁচার আগ্রহ দিলো, জীবনে যতদিন অবধি পৃথিবীতে আমাকে এক বিন্দুও প্রয়োজন থাকবে, ততদিন আমার মৃত্যু হবে না। যেদিনই আল্লাহ বুঝবেন যে, পৃথিবীতে এখন আর আমার না থাকলেও চলবে, তখনই আল্লাহ আমাকে নিয়ে যাবেন।
আব্বুর অসুস্থতা থেকে আজ অবধি আমি নিজেকে ধীরে ধীরে শুধরে নিয়ে উন্নত থেকেও আরও উন্নততর একজন মানুষে পরিনত করেছি। এখনকার আমি, এবং সেই আগের আমির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।
আগে সঠিক হলে, রেগে, নিজেকে আহত করে হলেও চেষ্টা থাকতো নিজেকে সঠিক প্রমাণের জন্য৷ মনে হতো, কবরে এক পা দিয়েই আমি যুদ্ধ করি, মরে গিয়ে হলেও নিজেকে সঠিক প্রমাণ করি।
কিন্তু এখন নিজের ভুল ত্রুটিগুলো চরমভাবে শুধরে নিয়েছি। এখন আর নিজেকে আহত করি না, জিদ করি না, রেগে যাই না সহজে, মনের মাঝে জিদগুলো জমাতে থাকি যেটা প্রয়োজন মত কাজে লাগাই।
এখন রাগও এতটাই কমিয়ে এনেছি যে হিসাব নেই ! রাগে গা জ্বলে গেলেও এখন আর জবাব দেই না, জবাবদিহি করি না, বেশিরভাগ সময় চেষ্টা করি চুপ থাকতে, তর্কে জড়াতে নয়। কেননা, মূর্খরা এই সুযোগটাই আশা করে, যেই মূহুর্তে আমি জবাব দিবো, প্রতিবাদ করবো, তখনই সুযোগ হবে আমাকে পাগল বা মানসিক রোগী প্রমাণ করার -যে চেষ্টা তারা হরদম চালিয়ে যাচ্ছে।
নিজে সঠিক হলে আসলে আওয়াজের প্রয়োজন হয় না। প্রতিবাদ অনেক সময় নীরব থেকে, কিছু না করে, পাত্তা না দিয়ে, কিছু লেখালেখি করেও সম্ভব হয়। তার থেকেও বড় জবাব হলো এই, প্রত্যেকের বিচার আল্লাহর কাছে দিয়ে দেয়া। আল্লাহ প্রকৃতির বিচার করে বুঝিয়ে দিবেন, এখনও পৃথিবী কোন না কোন অলৌকিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
কঠিন থেকে কঠিন সমস্যারও সুন্দর সমাধান সুন্দরভাবেই করা সম্ভব।
যাই হোক, আমার হিসেবে, বর্তমান আমিটা বিশ্বাস করি, “মানুষ মাত্রই ভুল-ত্রুটি করবেই। না করলে শিখবে কি করে, জানবে কি করে, বুঝবে কি করে বাস্তবতা। তবে সেই ভুল-ত্রুটি শোধরানোর মানসিকতাটাও থাকা জরুরী। এটাও খেয়াল রাখতে হবে, ভুল-ত্রুটি বলতে সেটাই হয় যেটা অজান্তে ভুল করে করে ফেলা হয়। ১ বার বা ২ বার বা ৫ বার৷ কিন্তু বারবার ইচ্ছাকৃত একই ধরনের ভুল আর ভুল থাকে না। অপরাধ হয়ে যায়। ভুলের ক্ষমা সম্ভব, তবে অপরাধের ক্ষমা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।”
মানুষ হিসেবে উন্নত সাকসেসফুল একজন মানুষ একমাত্র সেই হতে পারে যে কিনা নিজের জীবনের ভুল-ত্রুটিগুলো থেকে শিক্ষা নেয়, নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করে, নিজেকে আগের থেকেও উন্নত একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
আমাকে সবাই নানা কারনে সাকসেসফুল মানুষ বলতে বা মানতে চাইবে না। কারণ, লোকের কাছে সাকসেসফুল তারাই যারা আয় রোজগার করে, চাকরি বাকরি করে, বেশ ভাল পজিশন এচিভ করে, সফলভাবে সংসার করতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে যদি উন্নত এবং সাকসেসফুল কেউ হয় তবে আমাদের মত মানুষগুলোই সাকসেসফুল।
আমি নিজেও যেমন রোজ নানা ভাবে নিজেকে উন্নত ও পজিটিভ একজন মানুষ বানানোর চেষ্টা করছি ও অভ্যাস গড়ে তুলছি, আমার বাচ্চার বেলায়ও আমি সেইম কাজটাই করছি। আমার সাথে সাথে তাকেও শেখানোর চেষ্টা করছি, কি করে একজন উন্নত মানুষ হওয়ার প্র্যাকটিস করতে হয়।
ক্যারিয়ার বা টাকা পয়সায় উন্নত হওয়ার বিষয়টা আল্লাহর হাতে। তবে মানুষ হিসেবে সাকসেসফুল হতে হলে আমার মত একজন রিমি হয়ে ওঠা খুবই জরুরী যে কিনা জায়গায় জায়গায় আছার খেয়ে খেয়ে ভেঙে, গুড়া গুড়া হয়ে পুনরায় নিজেকে জুড়ে নতুন কোন রূপে উন্নত কিছু বানিয়ে পুনরায় গড়া শিখেছি ও বাচ্চাকেও শেখাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ আমি সফল হবো।
মৃত্যু এলে আর যাই হোক, আফসোস করবো না। মেনে নিয়ে হাসিমুখেই যেতে চাই যে, আমার প্রয়োজন, দায়িত্ব, কাজ ফুরিয়ে গেছে। এখন আর পৃথিবীতে থাকার কোন কারণ নেই।