ছাত্রদের জন্য পড়ার টেবিল নাকি রাজনীতির মাঠ?


ছাত্রদের জন্য পড়ার টেবিল নাকি রাজনীতির মাঠ?
ছাত্ররা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ, সমাজ/রাষ্ট্রের তারাই আগামীর কর্ণধার। দেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী থেকে কমান্ডিং পর্যায়ে আগামীতে তারাই থাকবে নেতৃত্বে ও দায়িত্বে। তাদের কেউ হবে সমাজপতি, সমাজের ভালো মন্দ দেখাশোনার দায়িত্ব কাঁধে নিবে। কেউ ডাক্তার হয়ে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত দেবদূত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবে। কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে নতুন নতুন আবিষ্কারে মত্ত থাকবে এমনকি নাসার মত গবেষণাগারে গিয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনবে। কেউ মানুষ গড়ার মহান কারিগর শিক্ষক পেশাটাকে বেছে নিয়ে এই সমাজটাকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তুলবে। কেউ প্রবাসে গিয়ে নিজের ফ্যামিলির স্বচ্ছলতার পাশাপাশি এদেশের রেমিট্যান্সে বিশাল বড় অবদান রাখবে। কেউ হয়তো সমাজের অসহায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের তরে নিঃস্বার্থভাবে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিবে উজার করে। আবার কেউ এ জাতির মুখে আহার তুলে দেয়ার জন্য হবে আধুনিক কৃষক, সবুজ শ্যামল শশ্য দিয়ে ভরে দিবে এই প্রকৃতিকে। কেউ ২২ গজের ক্রিকেট মাঠে ব্যাট হাতে হাকাবে বিশাল বড় বর ছক্কা আবার কেউবা ড. ইউনুস সাহেবের মত নোবেল হাতে বিশ্বের বুকে এই দেশটাকে নতুন করে মেলে ধরবে। তাদের চোখেমুখে থাকবে রঙিন স্বপ্ন, তারাই সৃষ্টি করবে নতুন ইতিহাস, যেমন করেছিলো ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭১, ৯০ এবং ২৪ এর ৫ই আগস্ট। তারা স্বপ্ন দেখবে, পরবর্তী প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাবে। তারা গাইবে দিন বদলের গান, তারা হবে এ জাতির প্রাণ।
এই যে এতকিছু, এরজন্য দরকার নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব ও আত্মার বন্ধন। আদৌও কি তাদের নিজেদের মধ্যে এই সম্পর্ক আছে? তারা কি আদৌও নিজেদের বুদ্ধিতে চলছে নাকি কারো ইশারা/বলীর পাঠা হয়ে নিজেদের স্বাধীনচেতা সত্তাটাকে বিলীন করে দিয়ে রিমুট চালিত পুতুল/রোবটের মতো জীবন যাপন করছে? একটিবার এই চিন্তাটা কেউ করেছে, ভেবে দেখেছে? আজ তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল/অঙ্গসংগঠনে নাম লিখিয়ে একেকজন হয়ে উঠছে খুবই বেপরোয়া, হিংসাপরায়ণ ও আক্রমনাত্মক। কোনো কারণ ছাড়াই একজন হয়ে যাচ্ছে আরেকজনের চরম শত্রু। ফলস্বরূপ নিজের এলাকার সহপাঠী, বন্ধু, আত্মীয়, শুভাকাঙ্খী, ভাই, ভাতিজা, সমবয়সী, ছোটভাই এমনকি একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একই বেঞ্চে বসে ক্লাস করা নিজের প্রিয় ক্লাসমেটের গায়েও ধা’রালো অ’স্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করছেনা। এক রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলের নিজের খুব কাছের প্রিয় বন্ধুটিকে মুহুর্তেই বানিয়ে ফেলছে চরম শত্রু। যেই ক্লাসমেট/বন্ধু/ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে একটু আড্ডা না দিলে, এক কাপ চা না খেলে সারাদিনটাই কেমন পানসে লাগতো অথচ শুধুমাত্র সামান্য রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে তারা সেই ক্লাসমেট/প্রিয় বন্ধু/স্নেহের ছোট ভাইটাকে ধা’রালো অ’স্ত্র দিয়ে কু’পিয়ে হয় দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিচ্ছে নয়তো পাঠিয়ে দিচ্ছে হাসপাতালে, অতঃপর সারাজীবন পঙ্গুত্ব বরণ। কার জন্য করছে এসব? কাকে খুশি করার জন্য? কার নির্দেশে? সে কি তাদের এই ক্লাসমেট, বন্ধু, স্নেহের ছোট ভাইটির চেয়েও প্রিয়? একটাবার যদি গভীর মনযোগ দিয়ে একটু চিন্তা করতো, মনে করতো তাদের কারো বাবা/মা/ভাই/বোন হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। সামান্য এক ব্যাগ ব্লাডের জন্য পৃথিবীর আলো দেখতেও পারে অথবা চিরতরে জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে যেকোনো সময়। শুধুমাত্র সামান্য এক ব্যাগ ব্লাড হলেই তাদেরকে বাঁচাতে পারে কিন্তু পুরো পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুজেও এক ব্যাগ ব্লাড ম্যানেজ করতে পারছেনা। নিজের রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরাও কোনো হেল্প করতে পারলোনা। অথচ খোজ নিয়ে দেখা গেলো তারই আঘাতে নি’হত অথবা আহত পঙ্গু সেই ক্লাসমেট/বন্ধু/স্নেহের ছোট ভাইটার ঠিক একই গ্রুপ। যার কাছে ব্লাড চাওয়ার আগেই পেয়ে যেতো। যে কি-না সাথে সাথেই বলে উঠতো ভাই কোনো চিন্তা করিসনা আঙ্কেলের ব্লাড আমি দিব। দোস্ত একদম কোনো টেনশন নিবিনা আন্টির যত ব্যাগ ব্লাড লাগে আমি দিব, প্রয়োজনে পুরো পৃথিবী তন্ন তন্ন করে হলেও যেখান থেকেই হোক ম্যানেজ করে এনে দিব। ভাই ঘাবড়াবেননা আপনার ভাই/বোনের জন্য ব্লাড আমি দিব আমারও সেইম গ্রুপ। কিন্তু আর যে কিছুই করার নেই। তখন? তখন কি জবাব দিবে সে নিজেকে? আদৌও কি পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে? কারন এরা তো তার সেই ক্লাসমেট/বন্ধু/ছোট ভাই যারা তার হাতে হাত রেখে কাধে কাধ মিলিয়ে একসাথে হাটতো, খেলতো, গাইতো, আনন্দ ফূর্তি মজা শাস্তিতে দিনের পর দিন পার করে দিত। সুখ দুঃখের গল্প আড্ডাতে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিত। জীবনের দুঃসময়ে পাশে থেকে সাহস দিত, শক্তি দিত, শান্তনা দিত। দিনের পর দিন ভবঘুরে থেকে কোনো চাকরি হচ্ছেনা, কর্ম নাই, বেকার বলে অন্য সবার কাছেই অবহেলা, করুনা, ঘৃণা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের পাত্র হলেও কিন্তু তার সহপাঠী, বন্ধু, ছোট ভাইটা ভালবেসে ঠিকই কাছে টেনে নিতো। এদের কাছেই শান্তি, স্বস্তি ও সাহস। এরাই তার নিস্তেজ প্রাণে সতেজ অনুভূতি। আর তার রাজনৈতিক সংগঠন? কি দিয়েছে, কি দিচ্ছে, কি দিবে বলতে পারবে কেউ? রাজনীতিতে যতদিন প্রয়োজন ততদিন প্রিয়জন হয়েই থাকবে কিন্তু প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাবেনা। ওরা তাকে দিয়ে স্বার্থ আদায় করবে, তাকে দিয়ে তার নিজের এবং খুবই কাছের লোকগুলোকে ঘায়েল করবে, তাকে দিয়ে তার প্রিয়দেরকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিবে নয়তো পঙ্গু বানিয়ে ঘরে ফেলে রাখবে। তার প্রিয়দের থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখবে। অবশেষে বয়স পঞ্চাশ ষাট পার হয়ে জীবনে এমন একটা সময় আসবে যখন কর্মব্যস্ততা থেকে অবসর নিয়ে বাসায় দিন কাটবে। সংসার জীবনে সবকিছু থেকেও নিজেকে খুব অসহায় এবং একা অনুভব হবে। কোনো কাজে মন স্থির থাকবেনা, সারাক্ষণ নিঃসঙ্গ আর অস্থির অস্থির লাগবে। মনে হবে একাকীত্ব আর শূন্যতা দিন দিন নিজেকে গ্রাস করছে, আর তখনি প্রতিনিয়ত মিস করবে তার ফেলে আসা অতীতকে। মিস করবে অতীতে হারিয়ে যাওয়া তার সেই ক্লাসমেট, বন্ধু ও ছোট ভাইদেরকে। তখনি অতীতের স্মৃতি হাতড়িয়ে ফিরে পেতে চাইবে সেইসব বন্ধুবান্ধব ক্লাসমেট ছোট ভাইদের। তাদের সাথে শেয়ার করতে চাইবে জীবনের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার গল্প। তখন? তখন কোন অধিকারে, কোন মুখে তাদের সামনে দাঁড়াবে? কারণ সব সম্পর্কই তো সে নিজে নষ্ট করে দিয়েছে সেই স্কুল কলেজ ভার্সিটিতেই। অনেককেই তো পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিয়েছে, আবার কাউকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলে রেখেছে ঘরের বিছানায়। আর তখনি এই চাপা কষ্টগুলো তাকে দিনের পর দিন কুরে কুরে খাবে। সুখ চাইবে কষ্টরা ঘিরে ধরবে, শান্তি চাইবে কিন্তু অশান্তির আ’গুনে জ্বলবে আর পু’ড়বে।
শুধুমাত্র ছাত্র রাজনীতি দিয়ে রাজনৈতিক কোনো দলের ব্যানারে সফল কোনো ছাত্র আন্দোলনের উদাহরণ এই দেশে আছে বলে আমার মনে হয়না। বাংলার ইতিহাসে ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭১, ৯০ এবং সর্বশেষ এই ২৪ এর ৫ই আগস্ট, বাংলার প্রতিটা বিপ্লবী ও গুরুত্বপূর্ণ সফল আ’ন্দোলে ছাত্রদের ভুমিকা ছিলো প্রধান। তবে তারা কিন্তু কেউ কোনো রাজনৈতিক ব্যানারে নয় বরং সাধারণ ছাত্রের ব্যানারে একসাথে হাতে হাত রেখে কাধে কাধ মিলিয়ে এগিয়ে গিয়েছে এবং সফল হয়েছে। রাজনৈতিক ট্যাগ ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র একটাবার সাধারণ ছাত্র হয়ে দেখলে দেখা যাবে আসলে জীবনটা কত সুন্দর, কত শত হাজার লক্ষ মানুষের সম্মান শ্রদ্ধা ভালবাসা আদর স্নেহ এই ছাত্রদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিশ্বাস না হলে এমন অনেক উদাহরণ আছে যা খুজলে সত্যি সত্যি বেরিয়ে আসবে। আমি নিজেও এর বাস্তব উদাহরণ। আমিও একটা সময় রাজনীতি করেছি তবে এতটা বেপরোয়া না। নাওয়া খাওয়া ফেলে শ্রম দিয়েছি, সময় দিয়েছি, মিছিল করেছি, মিটিং করেছি। কোনো এক সময় শুধুমাত্র আমার মায়ের কথায় রাজনীতির মাঠ ছেড়ে দূরে সরে এসেছি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি, অনেক সুখে আছি।
এখন আমি সবার সাথেই চলি মিশি হেসেখেলে জীবন কাটাই। মানুষের ভালবাসা সম্মান শ্রদ্ধা কত প্রকার ও কি কি আমি উপভোগ করছি। দলমত নির্বিশেষে সকলের ভালবাসা হয়ে ভালবাসা নিয়েই বেঁচে আছি।
অবশ্য ছাত্রদেরকে বলবোনা রাজনীতি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে। রাজনীতি অবশ্যই করা যায়, যেই রাজনীতি সত্য ও ন্যায়ের পথে চলে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে শেখায়। যেই রাজনীতি আত্মীয়, শুভাকাঙ্খী, সহপাঠী, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে শেখায় সেই রাজনীতি অবশ্যই করা যায়, হাজারবার করা যায়। নয়তো ছেড়ে দেওয়া উচিৎ ওই নষ্ট রাজনীতি যা মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করেনা, সম্পর্কের কোনো মূল্য দিতে জানেনা, যেখানে স্বার্থ নিয়ে খেলা হয়, যেখানে অকাতরে জীবন দিতে হয়, যেখানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা হয়। একজন ছাত্রের দিকে তাকিয়ে আছে একটি সমাজ, একটি সুন্দর রাষ্ট্র। আজকের এই ছাত্রের অপেক্ষায় আগামী।
একজন ছাত্র তার মা বাবা পরিবার এবং সমাজের এক আদর্শ সন্তান হিসেবে নিজেকে মেলে ধরুক এটাই প্রত্যাশা।
লেখক ও কলামিস্ট
এস এম মিজানুর রহমান মামুন