একজন যোদ্ধার না বলা কথা


ছোটবেলা থেকেই যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার একটা অন্যরকম সম্মান শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আছে। উনারা জাতির সূর্য সন্তান, উনারা এদেশের বীর, উনাদের জন্যই আজ নিজেকে একজন বাঙ্গালি হিসেবে পরিচয় দেই। সময় পেলেই মুরুব্বিদের কাছ থেকে যু-দ্ধের বিভিন্ন গল্প শুনতাম। আব্বা নিজেও মাঝেমধ্যে আমাদেরকে ৭১ সালের বিভিন্ন গল্প শোনাতেন। আমরা ভাই বোনেরা অবাক হয়ে শুনতাম। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো মুভি হলে তা মনযোগ দিয়ে দেখতাম। স্কুল কলেজ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মান দেয়া হতো তখন নয়ন ভরে দেখতাম। এখনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখলে শ্রদ্ধায় অবলীলায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। আমাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, এটা নিয়ে সবসময় খুব আফসোস করতাম এবং এখনো করি। তো দেশের এই বীর সেনাদের প্রতি ভালবাসা আর দূর্বলতা থেকেই প্রায়ই নিজেকে মনে মনে বলতাম, ইশ আমার আব্বা যদি ৭১ এ দেশের হয়ে অ-স্ত্র হাতে তুলে নিতেন, দেশের জন্য ল’ড়াই করতেন তাহলে আজকে আমিও গর্ব করে বলতাম আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমার বাবা এদেশের একজন বীর সেনা।
একটা সময় যখন স্কুলে লেখাপড়া করি তখন একদিন কিছুটা সাহস নিয়ে আব্বাকে বলেই ফেললাম, আব্বা দেশে এত এত মানুষ দেশের জন্য লড়াই করেছে অস্ত্র হাতে দেশের জন্য জীবন বাজী রেখেছে আপনি কেন যু-দ্ধে যাননি? তাহলে তো আজ আমিও বলতাম আমার আব্বা একজন মুক্তিযোদ্ধা।
আমার প্রশ্নটা শুনে আব্বা সেদিন একটু অবাক হয়েছিলো এবং মুচকি হেসেছিলো কিন্তু আর কোনো উত্তর দেয়নি। এরপর থেকে প্রায় সময় সুযোগ পেলেই আব্বাকে একই প্রশ্ন করতাম কিন্তু আব্বার মুখে শুধু মুচকি হাসি অথবা চুপ করে থাকতেন। আব্বা যখন ৭১ সালের বিভিন্ন ঘটনা বলতেন তখনো প্রশ্নটা করে বসতাম, আর তখনি হয় কথা ঘুরিয়ে নিতেন নয়তো চুপ থাকতেন। আমার প্রশ্ন শুনে আব্বার মুচকি হাসা এবং চুপ থাকার রহস্য কখনো খুজে পেতামনা।
এরপর যখন বড় হতে থাকলাম, ৭১ সালের ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করলাম, ৭১ এ অংশগ্রহণ করা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সামনে বসে সরাসরি আলাপ করলাম তখন আমার আফসোসটা আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। এরপর কলেজ লাইফ কর্মজীবন এবং অল্প বয়সে কর্মজীবনের বিরতি নিয়ে বাড়িতে চলে আসা। আব্বাও চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়িতে। বাড়িতে থেকে ব্যবসা, ঘোরাফেরা এবং লেখালেখি আমার সঙ্গী হয়ে গেলো। আব্বা চাকুরীতে থাকাকালীন হয়তো কাছে খুব একটা পেতামনা, আমিও চাকুরীতে চলে যাওয়ায় দূরত্ব আরও বেড়ে গিয়েছিলো। যখন আমি ছুটিতে থাকতাম তখন আব্বার ছুটি নেই, আব্বা ছুটিতে থাকলে আমার ছুটি নেই। অবশ্য আমি ৩-৪ মাস পর পর ছুটিতে আসার সময় প্রত্যেকবার ঢাকা হয়ে আসতাম শুধু আব্বার সাথে দেখা করার জন্য, কারণ আব্বা ঢাকায় থাকতো। তারপর আব্বা স্ট্রোক করে অবসর নিলো, আর আমিও কিছুদিন পর স্বেচ্ছায় অবসরে চলে আসলাম। এরপর থেকেই বাড়িতে এবং খুব কাছে থেকে আব্বার আদর স্নেহ ভালবাসা পেয়েছি। এভাবে আব্বার সাথে থেকে কিছুটা জড়তা আর সব ভয় কেটে গিয়েছিলো। একটা সময় ভয়ে আব্বার সামনে যা বলতামনা সেটাও সাহস নিয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করে ফেলতাম। আর এভাবেই আমার ওই আফসোসের প্রশ্নটা প্রায় সময় করতাম, কিন্তু প্রতিবারের ন্যায় প্রায় সময় আব্বা চুপ অথবা মুচকি হাসি।
আমাদের উপজেলায় আব্বার জানামতে পরিচতদের মধ্যে কারা কারা সরাসরি যু-দ্ধে অংশ নিয়েছে, কে কে অরিজিনালি মুক্তিযোদ্ধা আবার যু-দ্ধে না গিয়ে যু-দ্ধ না করেও কে কে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন এসব নিয়েও আব্বা মাঝেমধ্যে আলাপ করতেন। আব্বার মুখে অন্যদের যু-দ্ধের বীরত্বগাথা কথা শুনতাম কিন্তু উনি কেন দেশের হয়ে যু-দ্ধে যায়নি এটা কখনোই জানতে পারিনি। মাঝেমধ্যে মনে হতো আব্বা কি তাহলে ভীতু ছিলো? কিন্তু আমার আব্বা তো কিছুতেই ভীতু হতে পারেনা, কারণ আব্বার বাহাদুরির কথা চাচাদের মুখে, এলাকার মুরুব্বিদের মুখে, আব্বার বন্ধুবান্ধবদের মুখে শুনেছি। উনারা তো কখনো মিথ্যা বলতে পারেনা, আর এত লোকের কথা কখনো মিথ্যা হয়না।
এভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। এরপর আব্বা দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার কয়েকমাস আগে যখন অসুস্থ হয়ে বিছানাবন্দী তখন বেশিরভাগ সময় আব্বার শিয়রে বসে কাটিয়েছি। আর এর ভেতরেই একদিন আব্বাকে আবার সেই প্রশ্নটাই করে ফেললাম। সাথে এও বললাম যে, আব্বা আপনি যু-দ্ধে যাননি কিন্তু যু-দ্ধের নিয়তে অন্তত বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার ফিরে আসতেন তবুও তো কিছুটা হলেও বলতে পারতাম আমার আব্বা যু-দ্ধ করার জন্য ঘর থেকে বের হয়েছিলো। আজকে যদি আপনি দেশের হয়ে অ-স্ত্র হাতে তুলে নিতেন তাহলে মাথা উঁচু করে চিৎকার করে বলতাম আমার আব্বা একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এই দেশের কাছে, দেশের মানুষের কাছে কিছুই চাওয়ার ছিলোনা, কোনো সুবিধা নিতামনা আমার আব্বা একজন মুক্তিযোদ্ধা শুধু এটা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে চলতাম।
আমার কথাগুলো শুনে আব্বা নির্বিকার, সেদিন আর মুচকি হাসি দেয়নি শুধু চুপ করে ছিলো। পাশেই বসা আব্বার ছোট বোন মানে আমার ফুফু আমার কথাগুলো শুনছিলো। হঠাৎ ফুফু বলে উঠলেন, তোর আব্বা যু-দ্ধ করেনি তাতে কি, একমাস ট্রেনিং তো করেছে। ফুফুর মুখে কথাটা শুনে আমি শুরুতেই থতমত খেয়ে গেলাম এবং মনে করলাম ফুফু আমার সাথে ফান করতেছে। তাই এবার কৌতুহল নিয়ে ফুফুকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, ট্রেনিং মানে? কিসের ট্রেনিং? তখন ফুফু বললেন, তোর আব্বা যু-দ্ধে যেতে পারেনি সত্য তবে যু-দ্ধের জন্য পাকুন্দিয়ার মফিজ মাস্টারের বাড়িতে থেকে ট্রেনিং করেছে।
মফিজ মাস্টার! কোন মফিজ মাস্টার? সাথে সাথেই মনে পড়ে গেলো যে এই মফিজ মাস্টারের কথা আব্বার মুখেই কোনো একসময় শুনেছি। আর আম্মার মুখে শুনেছি বহুবার। যেই মফিজ মাস্টার একজন শিক্ষক হয়েও দেশের টানে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে দেশের হয়ে যু-দ্ধ করেছেন। অ-স্ত্রহাতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেছেন। যিনি ছিলেন একজন সম্মুখ যো-দ্ধা এবং আঞ্চলিক মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। উনার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যু-দ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হতো। যেই মফিজ মাস্টার দেশের জন্য অ-স্ত্র হাতে পাক হানাদারদের ত্রা’স ছিলেন, সেই মফিজ মাস্টারই যু-দ্ধ পরবর্তী সময়ে অ-স্ত্র হাতে হয়ে গেলেন এদেশের জনগণের জন্যই ত্রা’স। উনার জন্য মানুষ আতঙ্কে থাকতো সবসময়। একটা সময় উনার পতন হলো, সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মফিজ মাস্টার নামটাও ধুলোয় মিশে গেলো।
আমি মফিজ মাস্টার সম্পর্কে ছোটবেলায় আম্মার মুখে এতটুকু শুনেছিলাম।
ফুফুর মুখে কথাটা শুনে আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেলো, ফুফুকে বললাম একটু বিস্তারিত বলার জন্য। তখন ফুফু বললো, তোর আব্বা কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া নয়া পাড়ার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মফিজ মাস্টারের বাড়িতে আরও অন্যান্য লোকের সাথে ১ মাসের মতো ট্রেনিং করেছে। ৭-৮ দিন বাড়ি থেকে গিয়ে আর ২২ দিন সরাসরি মফিজ মাস্টারের বাড়িতে থেকে এই মোট একমাসের মতো ট্রেনিং নিয়েছে। তোর আব্বা যু-দ্ধে চলে গেছে মনে করে তোর দাদী প্রতিটা দিন-রাত ছেলের জন্য কান্নাকাটি করে নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিছিলো। ছেলের জন্য তোর দাদীর এই কান্নাকাটি দেখে তোর দাদা তোর আব্বাকে ওই ট্রেনিং থেকে নিয়ে আসছে, আর যেতে দেয়নি। এরপর যতদিন যু-দ্ধ ছিলো ততদিন তোর আব্বার পিছনে পাহাড়ায় লোক লাগিয়ে রেখেছিলো যেন পালিয়ে চলে যেতে না পারে।
ফুফুর মুখে কথাগুলো শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাহলে এতদিন কেন শুনিনি? আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আব্বা একদম নীরব নিস্তব্ধ, মনে হচ্ছে আনমনে কোনদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আব্বাকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম যে আপনার বোন যেই কথাগুলো বলেছে তা কি ঠিক? আব্বা মাথা ঝাকিয়ে এবং মুখ দিয়ে হুম শব্দটা বের করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো। আমি বুঝতে পারছিলাম আব্বার মনের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে একটা চাপা কষ্ট কাজ করছিলো। যু-দ্ধে যেতে না পারার আফসোস আক্ষেপ এবং কাউকে বলতে না পারার মানসিক একটা অশান্তি হয়তো উনাকে ভোগাচ্ছিলো। আজ হয়তো সেটা হালকা হয়েছে তাই দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়েছে।
আমি সেদিন বুঝেছিলাম আব্বার চুপ হয়ে থাকার রহস্য, এড়িয়ে চলার রহস্য এবং মুচকি হাসির রহস্য। আমি খুশিতে আনন্দে আবেগে আত্মহারা হয়ে সাথে সাথে আব্বার বুকে মাথা রেখে আব্বাকে জাপ্টে ধরলাম। আর বললাম আমার আর কোনো আফসোস নেই, এতদিন আমার যা চাওয়ার ছিলো যেই আফসোস ছিলো আজ তা পূরণ হয়ে গেছে। আমার আব্বা ভীতু নয়, আমার আব্বা একজন প্রকৃত বীর, আমি একজন বীর বাহাদুরের সন্তান। আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধা নয় কিন্তু তারপরও তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
কত মানুষ যু-দ্ধ না করে, হাতে অ-স্ত্র না নিয়েও বাড়িতে বসে থেকেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাগিয়ে নিয়েছে। অথচ আমার আব্বা সেই চেষ্টা তো দূরে থাক বরং এমন চিন্তাও করেননি কখনো। সরকারের দেয়া সুযোগ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সামান্য সহযোগিতা করার জন্য, আশ্রয় দেওয়ার জন্যেও অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছে। আর আমার আব্বা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে থেকে প্রশিক্ষণই নিয়েছে পুরো একমাস, যার ফলে ইচ্ছে করলেই নিজের নামে একটা সনদ করে নিতে পারতেন কিন্তু উনি তা করেননি। হয়তো অ-স্ত্র হাতে সরাসরি যু-দ্ধ করতে না পারার আক্ষেপ থেকে অথবা অপূর্ণতা থেকে।
এজন্য আমার আব্বাকে স্যালুট।
এই চরম সত্য এবং দীর্ঘদিন না বলা কথাটা যখন জানতে পারলাম তখন থেকে যতদিন আব্বা জীবিত ছিলেন আমি এবং আমাদের পরিবারের কেউ ভুলেও কোনদিন চাইনি সনদে নাম উঠুক। আমি এবং আমরা আব্বার আদর্শে অনুপ্রাণিত। আব্বা যু-দ্ধে যেতে পারেনি, অ-স্ত্র হাতে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়তে পারেনি কিন্তু এরপরেও যা করেছে তা আমার এবং পরিবারের কাছে বিশাল বড় অর্জন।
আজ আব্বা নেই, কথাগুলো দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে আওড়াচ্ছিলো এজন্য লিখে নিজেকে হালকা করলাম এবং একটা ডকুমেন্ট হিসেবে রেখে দিলাম।
লেখক ও কলামিস্ট:
এস এম মিজানুর রহমান মামুন
নির্বাহী সম্পাদক
দেশেরবার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকম