একজনের জন্য যেনো অন্যজন বঞ্চিত না হয় – মারুনা রাহী রিমি


মা, বোন, বউ ও কন্যা একটা পুরুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক নারী। কাউকেই ফেলে দেয়া যায় না বা অসম্মান করা যায় না বা অমর্যাদা করা যায় না। এদের প্রত্যেকের মাঝেই একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখা পুরুষের অবশ্য করনীয় একটা কর্তব্য। কিন্তু আসলেই কি পুরুষ এই কর্তব্য পালন ও সামঞ্জস্যতা রক্ষা করতে পারে? প্রায় পুরুষেরই একটা বক্তব্য থাকে। তাদের নাকি মা ও বউ এর মাঝে পিষতে হয় বা বোন ও বউ এর মাঝে পিষতে হয়। কিন্তু বউ ও কন্যার মাঝে তো কখনও পিষতে হয় না। বিষয়টা অদ্ভুত না? বরাবরই আমার মনে হয়, এমনটা হবারই তো কথা নয় যদি ন্যায়, সত্য ও সঠিক পথে কেউ থাকে। কারন তখন তাকে আর কোন সম্পর্কের মাঝে বাছতে হবে না। সে ন্যায়টা করে যাবে তা যার সাথেই করতে হোক না কেন। তাহলে তাদের মাঝে পিষতে হয় কি করে তাকে? আমার পরিচিত এক আপা অনেক কষ্ট করে মানুষের বাসায় কাজ করে ২ ছেলে লালন পালন করে বড় করে। ছেলে বিয়ে করতে না করতে ১ মাসও যায় নি তার ছেলেকে বউ আলাদা বাসা নিতে।
মায়ের সব জানার পী বউ এর প্রতি তিক্ততা ও বউ এর এমন ডিমান্ড ও বাড়ি ছেড়ে দেওয়া, আত্মহত্যার হুমকি ইত্যাদি ইত্যাদিতে ছেলেটা নাকি বিষিয়ে উঠেছে৷ বউও ছাড়তে পারে না আবার মা ও বউ দুজনকে একসাথে রাখাও সম্ভব না। কথায় কথায় মায়ের সাথে খারাপ আচরন, গালি গালাজ করে। এমন ক্ষেত্রেও ছেলেটার পিষে চলাই আমার লজিক ছাড়া মনে হচ্ছে। কেননা, জন্ম দিলেন যে মা, কোলে পিঠে মানুষ করার পর বিয়ের মাসখানেকও যায় না আলাদা বাসা নিতে বলা বউটা কেমন ভাল মানুষ হতে পারে যে কারো বোঝার কথা। ভালবাসায় অন্ধ ছেলেটা নাকি এই বউ ছাড়াও থাকতে পারবে না, আবার মা কেও ছাড়তে পারবে না। এমন বউদেরই আগে বুঝিয়ে একসাথে রাখার চেষ্টা করে বের করে দেয়া উচিত নয় কি? আবার আমার পরিচিত আরেকজনকে দেখলাম, বউ এর সাথে কি হলো না হলো, সেই জন্য আপন বোনকেই তাদের পরিবার ছাড়া করে দিলো বাজে ব্যবহার, অপমান অপদস্ত করে করে। অথচ তাকে ভেবে চিন্তে লজিকালি দেখা উচিত ছিল, সঠিক বিষয়টা আসলে কি? আসলে দোষটাও কার বা কি? বোনের দোষ হলেও সে বেশি হলে তার বোনকে আপন মা বাবা থেকেও দূর করা ন্যায়সঙত কাজ নয়। অথচ বিনা দোষে তাদের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা বোনটাকেও ফেলে দিল বউ ও বউ এর পরিবারের প্ররোচনায় পড়ে।
এমন আরেকজনকেও চিনি, যিনি কি না বউ শুধু নয়, কাজের লোকের জন্য পর্যন্ত আপন মায়ের বুকের দুধের দাবী পর্যন্ত ভুলে যা না তা ব্যবহার করতো যখন মনে চায় তখন। মাঝে মাঝে বউ এর অন্যায় ভাবে অনেক কথা বলা, কথায় কথায় বিচার দেয়া, ছোট খাটো জিনিসের জন্য অপমানজনক ব্যবহারও তোয়াক্কা করতো না। দোষ বরাবরই তার মায়ের দিতো। অদ্ভুত লাগতো এই ভেবে যে, তার এতে কোন অনুশোচনাও জাগতো না। এমন একজনকে বাস্তবেই দেখেছি যিনি কিনা তার মা ও বোনের জন্য নিজের বউকে দিনের পর দিন ছোট থেকে ছোট যেকোন বিষয় থেকে বঞ্চিত করতো। মা ও বোনের দোষ জেনেও কখনও প্রতিবাদ করতো না। বউ প্রতিবাদ করলে পুরো পরিবার মিলে উল্টো বউটাকেই নানা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সালিশী বসিয়ে সব দোষ তার উপরেই চাপিয়ে দিতো। এরপর যদি কখনও বউ এর উপর চাপাতে না পারতো, তখন অন্য কারো উপর চাপিয়ে যেতো মা ও বোনের অপরাধগুলো। হয় অন্য কোন বউ বা বুয়া বা কাজের লোক। প্রায়ই তাকে দেখতাম মা ও বোনের সম্মান রক্ষা করতে জানও প্রায় দিয়ে দেয়। বউ চলে গেলেও বউকে মা ও বোনের অন্যায় শুধরে ফোন পর্যন্ত করতে দেয় না। কারন তারা মনে করে, বউদের মানাতে চাইলে বা ফিরে যেতে বললে তাদের মা ও বোনের অসম্মান হবে। অথচ সে নিজেও জানে যে দোষটা তাদেরই ছিল।
মজার বিষয় হলো, মা ও বোনের অহংকার, দাপট, মিথ্যা সম্মান বাঁচাতে গিয়ে একেক ভাইয়ের বউ এই যে গেল, আর ফিরলো না। কোন বউ আলাদাই হয়ে গেলে নিজেদের সম্মান নিজেরা বাঁচাতে তো কোন কোন বউ আর ফিরলোই না। ওই যে, তাদের শাশুড়ী ও ননদের সম্মান যে নষ্ট হবে স্বামীর সাথে ভাল থাকলে ও সংসার করলে। সঠিক-বেঠিক কি আমার জানা নাই। তবে আমার মনে হয়, মা ও বোনের সম্মান যদি মূল্যবান হয় তবে বউ এরও তো সম্মান আছে। কেউ বোনের মিথ্যা সম্মান রাখতে বউ বা বাচ্চাও নিজের থেকে দূর করে দিতে পারলে, বউ ও নিজের সন্তানের সম্মান রাখতে পারাও তো জরুরী। আরও অদ্ভুত লাগে, নিজেদের দোষেই একেকজন যখন সংসারহীন অপরিপূর্ণ জীবন যাপন করছে, তখনও তাদের অনুশোচনা তো জাগেই না, উল্টা পিঠ পিছে, আড়ালে বানিয়ে বানিয়ে সেইসব বউদের দোষ রেডি করে মানুষের কাছে গীবত করার মত। আমার হাসি পায় এই ভেবে যে, আসলে তারা কাকে ঠকাচ্ছে? আল্লাহকে নাকি নিজেদের নাকি বউ বাচ্চাদের নাকি যাদের এমন মুখরোচক মিথ্যা বানানো গল্প দিয়ে বউ বদনাম করে বেড়াচ্ছে তাদের? আসলেও কি তারা সফল হচ্ছে?
সব কথার শেষ কথা, সম্মান যদি রাখতেই হয় তবে আপনার জীবনের সকল নারী সম্পর্কের রাখুন। বউ বলে সম্মান করতে নেই বা বোন বলে সম্মান করতে নেই বা মা কে সম্মান দেয়ার কি আছে এসব ভাবার অবকাশ রাখে না। মা অন্যায় করলেও মা কে ফেলা যাবে না বা মায়ের সাথে খারাপ আচরন বা গালিগালাজ করা যাবে না। কারন, যে কষ্ট নিয়ে আমাদের গর্ভে রেখে এই মায়েরা জন্ম দিয়ে এত বড় করেছেন সেই ঋন কোনদিন শোধ সম্ভব নয়। কিন্তু বুঝিয়ে অবশ্যই বলতে পারেন বা তার ভুলটা শুধরে দিতে পারেন। তবে অবশ্যই নিজের দায়িত্ব ভুলে নয়। বোনের বেলায়ও একই বিষয়। ছোট বোন অন্যায় করলে, ভুল করলে রাগ করতে পারেন, বোঝাতে পারেন, শুধরাতে পারেন। তবে কোনদিনই তার দায়িত্ব ভুলে গিয়ে নয়। কেননা, মায়ের পর এই বোনেরাই আপনাদের আগলে রাখার মত কেউ ছিল যারা হয়তো আপনাকে ফেলতে পারবে না। বউ এর বেলায়ও একই বিষয়। তার সম্মান তাকে দিন, তার দায়িত্ব পালন করুন যথাযথ ভাবে। সে যদি অন্যায় করে বা আপনাকে আপনার পরিবার থেকে দূর করতে চেষ্টা করে কোন প্রকার লজিক্যাল কারন ছাড়া বা আপনার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য কিছু না করে উল্টা আপনাকেই তাদের থেকে দূর করতে চায় তবে আপনার অধিকার রয়েছে কঠিন ব্যবস্থা নেবার। অন্যায় ভাবে এই কাজ করলে সে আপনার কেন, কারোই সঠিক জীবনসঙী নয়। তার হক আদায় করে, দায়-দায়িত্ব পালন করে তাকে দূর করে দেয়ার অধিকার আল্লাহও আপনাকে দিয়েছেন।
সেটাই করুন যেটা ন্যায়সঙত। তাহলে কোন সম্পর্কই আপনাকে পিষতে পারবে না। কারন আপনি ন্যায় করছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন, ভুল শুধরাচ্ছেন। সম্মান করতে চাইলে সবাকে যার যার হকের সম্মান দিন। ভালবাসুন সবাইকে। তবে একজনের জন্য অন্যজনকে কখনও বঞ্চিত করে নয়।
মারুনা রাহী রিমি, লেখক ও কলামিস্ট