শূন্যতার শূন্য রিমি’র চিঠি


প্রিয় অনন্ত,
আজ খুব করে মনে পড়ছে তোমায়। মন চাইছে মন খুলে মনের কিছু কথা লিখে যাই। জানি তোমার সময় নাই আমার চিঠি পড়ে দেখার, কোন ইচ্ছাও নাই। কণা কে নিয়ে তুমি বেশ আছো। তবে তুমি জানো আমার চিঠি লেখা খুব ভাল লাগে। তোমার হয়তো কেউ আছে। আমার তো তুমি ছাড়া কেউ ছিল না। তবে আমি খুব খুশি। তুমি আমাকে ছেড়ে গেলেও দিয়ে গিয়েছিলে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহারটি। আমাদের ফুটফুটে বৈশাখী।
আমরা সব সময় কেন যেন শুধু একে অপরের ভুল, দোষ, ত্রুটি নিয়েই ঘেটেছি। আমাদের মাঝের সেই ভাল দিক গুলো ভুলেই গেছি। তোমার হয়তো আমার ভাল গুলো কিছুই মনে নেই। আমার কিন্তু সব মনে আছে।
জানি আমাকে তোমার মনেই পড়ে না। কি করেই বা পড়বে? আমি তো কোনদিন তোমার মনেই ছিলাম না। এই দুঃখটা আমার সারাজীবন রয়ে যাবে যে, আমি এত কিছুর পরেও পারি নি তোমার মনের ঘরে একটু জায়গা করতে। তোমার মনে সবার জন্য জায়গার অভাব ছিল না। কেন যেন তার একটা কোণও আমার ভাগ্যে জুটলো না।
আমার কিন্তু তোমাকে বেশ মনে পড়ে। তোমার সাথে কাটানো সেই মধুর মূহুর্তগুলো, আমার জন্য করা তোমার ছোট ছোট কাজ ও সাহায্যগুলো, আমার সাথে করা সেই দুসটু মিষ্টি গল্পগুলো, তোমার সেই দুসটামি গুলো, তোমার হাত ধরে রিকশায় করে ঘুরে বেরানো, পরিবারকে লুকিয়ে আমার জন্য করা ছোট ছোট কাজগুলো। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তোমার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকার সময় তোমার হার্টবিট শোনা। কি যে ভাল লাগতো তোমাকে কখনও বলে বোঝানো যাবেনা।
মজার একটা বিষয় তোমাকে আমার বলা হয় নি। আমার সাথে জড়িয়ে কোন ছেলের কথা, কল, চ্যাট বা পছন্দ করার গল্পে তুমি খুব হিংসা করতে, ক্ষেপে যেতে। তোমাকে এমন হিংসা করতে দেখে, এতটা প্রটেকটিভ হতে দেখে আমার বেশ মজা লাগতো। তাই প্রায়ই আমি মজা করে তোমাকে এর ওর কথা মিথ্যামিথ্যি বলেই ক্ষেপাতাম তোমাকে। তাই কখনও তোমাকে আমার ফোন চেক করতে বাধা দিতাম না। আবার ভয়ও হতো। যদি আমার মিথ্যা ধরা পড়ে যাই। আমার কল লিস্টে তো তুমি কিছুই পাবে না। মেসেনজারে আমাকে কল করতে দেখলেও রিসিভ করতে বা কথা বলতে তো পাবে না। ভয় হতো, যদি বুঝে যাও আমি দুসটামি করছি।
কিন্তু তুমি কোনদিন ধরতে পারো নি, বুঝো নি। কল লিস্ট তো কখনও চেক ই করো নি। কিন্তু মেসেনজারে আমাকে কেউ কল করলে বা নক করলেও উল্টা আমাকেই ভুল বুঝে দোষ দিতে। কোনদিন ভেবে দেখো নি আমি তো কারও ফোন ধরি নি, চ্যাটও করি নি, যদিও বা করেছি কতটুকু বা কি কি বলেছি। উল্টো আমার এই দুসটুমি করে বলা মিথ্যাকেই বাড়িয়ে বলে সবার সামনে আমাকে চরিত্রহীনা বানিয়ে দিয়েছিলে।
আমার সাথে থাকা অবস্থায় তো কতবার মাঝ রাতে তোমার আগের প্রেমিকা কণা কল করেছিল। কই, আমি কি কিছু বলেছিলাম? নাকি সবার সামনে কোনদিন বলে তোমাকে চরিত্রহীন বানিয়েছিললাম? আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কারন কলটা সে করেছিল, তুমি নয়। ভালবাসার মানেই তো বিশ্বাস। তুমি আমাকেই একটু বিশ্বাস করতে পারো নি কখনও। কেনই বা পারবে! ভালবাসা ছিলই বা কোথায়!
আমি তোমার জন্য আজও দোয়া করি সেই আগের মত। একদিন তুমি অনেক বড় হবে। অনেক টাকা পয়সার মালিক হবে। এটাই তোমার আসল চাওয়া ছিল তাই না? আমাকে বিয়েটাও হয়তো এই জন্যেই করেছিলে। ভুল করে ভরা হাড়ি মনে করে খালি হাড়িটা নিয়ে নিলে। এখানেও কি আমারই দোষ ছিল?
তবে আজ তোমার সেই সব আছে যা তুমি চেয়েছিলে। এই জন্যেই হয়তো ভুলেই গেছো ঠিক কোন সময়টা আমি তোমার হাত ধরেছিলাম সব জেনে শুনে। তুমি বলেছিলে তোমার কিছুই নাই, তুমি একদম বেকার, তুমি আমাকে সামান্য কিছুও দিতে পারবে না। আমি শুধু মানুষটার হাত ধরেছিলাম। ভেবেছিলাম পাশে থেকে তোমার উপরে উঠা দেখবো ও আমার ভালবাসা দিয়ে সাপোর্ট করে যাব।
সস্তা থেকেও সস্তায় আমাকে ঘরে তুলেছিলে বহুদিন পর। কোনদিন আফসোস করি নি। শুধু ভেবেছিলাম, তোমার সংগই আমার জন্য সব কিছু। আমাদের স্ট্যাটাসে তোমার পরিবার খাপ খাওয়াতে পারে নি। আমারা নিজেদের টাকায় সেই স্ট্যাটাস বজায় রেখে তোমাদের নাম দিয়েছিলাম তোমাদের সম্মান বজায় রাখতে।
তুমি দিব্যি ভুলে গিয়েছিলে কিভাবে আমি তোমার সকল প্রয়োজনে পাশে ছিলাম ঢাল হয়ে। তোমার নানা বিলাসিতার খরচ বহন করেছিলাম আমার একটু একটু করে অনেক কস্টে জমানো টাকা দিয়ে। সব শেষ হবার পর মা এর কাছ থেকে নিয়েও করতে হতো আমাকে। ধারের নামে কত নিয়েছিলে না তোমার মনে আছে, না আমার। অনেক অভাবে, কস্টেও তোমার সাপোর্ট পাই নি কখনও। অথচ একবারও আমার কস্ট তোমার মনকে নাড়ায় নি। কি করেই বা নাড়াবে? আমি তোমার মনের মাঝে ছিলামই কবে!
তোমার হয়তো মনে পড়ে না, শত অসুস্থতার মাঝেও আমি সেই সব কিছু করেছিলাম যা তুমি নিজেও মানতে যে আমি মায়ের বাসায় কোনদিন করি নি। সকাল সকাল উঠে পুরো দিন কাজের বুয়ার মত কাজ। নতুন বউ হয়ে বাসায় প্রবেশ করতেই বুয়া ছিল না। পুরো দিন কিভাবে খেটেছি তোমরা সবাই দেখেছিলে। দিন শেষে পুরো শরীর ব্যাথায় ভেঙে আসতো। তবুও তোমার পা ও শরীর টিপে মাসাজ দেয়া, নখ কেটে দেয়া, পেডিকিওর করে দেয়া, মাথায় তেল মালিশ ও অন্য কোন চাহিদার জন্য মানা করি নি।
তোমার তো আমার গর্ভকলীন সময়ের কথাও মনে নেই। সেই অবস্থায়ও কোনদিন তোমার এই ধরনের কোন চাহিদার ক্ষেত্রে মানা করি নি। ডাক্তার হাই প্রেসারের জন্য পুরো বেড রেস্ট দিলেও তোমাদের বাসায় সকাল থেকে কাজ করে পায়ে পানি এসে যেত। বেবির অবস্থা সিরিয়াস না হলে এভাবেই চলত তোমাদের বাসায়। তবুও কখনও মানা করি নি।
বিয়ের পরে আমার জন্মদিন, ভ্যালেনটাইন ডে, পহেলা বৈশাখ, ঈদ, ম্যারিজ ডে এসব বিশেষ দিন গুলোর কথা মনে পড়ে? আমার বিয়ের পর প্রথম জন্মদিনে নিজের টাকায় কেক অর্ডার করে তোমাকে নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দিতে বলেছিলাম যাতে আমার পরিবার মনে করে তুমি আমাকে কত ভালবাসো। জানো, আমি খুব অপেক্ষায় ছিলাম তুমি আমাকে একটা ফুল হলেও দিবে ও আমি সেটা ডায়েরিতে রেখে দিব। তুমি খালি হাতে এসেছিলে। হয়তো আমার জন্য গোলাপটাও তোমার বেশি মনে হয়েছিল।
একমাত্র বিয়ের পর ১ম ভ্যালেন্টাইন ডে তে একটা ৩০০০ টাকার শাড়ী দিয়েছিলে। এত দামী শাড়ি না দিয়ে কম দামী কিছু দিলেও আমি খুশি হয়ে যেতাম। কেননা আমার কাছে ভালবেসে তোমার দেয়া সামান্য একটা চকলেট বা ফুলও অনেক মূল্যবান ছিল। কিন্তু এই অনুভূতি তুমি কোনদিন বুঝো নি।
থাক আমাদের অতীতের কথা। আজ আমরা ভাল আছি এটাই আসল। তুমি তোমার কণা কে নিয়ে, আর আমি আমাদের বৈশাখীকে নিয়ে। তুমি উন্নতি, সফলতা ও কণাকে নিয়ে ভাল আছো মনে করেই আমি ভাল থাকি। আর তোমার বেবিটা দেখতে একদম তোমার মত। তোমাকে মিস করতেই দেয় না।
জানো অনন্ত, আমাদের বৈশাখী এখন বসতে পারে। সেদিন তো অনেক বার পাপা পাপা করেছে। ভিডিও করে রাখতে পারলে দিতাম তোমাকে। আবারও পাপা বললে ভিডিও করে রাখার চেস্টা করব। তোমার অনেক ভাল লাগবে।
জানো, বৈশাখীকে আমি নিজেই ন্যাড়া করে দিছি। নাপিতের খরচও এখন আমাদের জন্য বিলাসিতা। তবে অনেক সুন্দর হয়েছে। নাপিতও এত সুন্দর করে কাটতে পারতো না।
একটা কথা বলে আজ শেষ করবো যা তোমাকে কখনও বলা হয় নি। তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল। আর তোমার দেয়া শেষ উপহারটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দামী উপহার। ধন্যবাদ তোমায় আমাকে আমার বৈশাখী দেয়ার জন্য।
ভাল থেকো। ভালবেসে যাব আজীবন।
বিদায়