পুরো পৃথিবীটাই কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে, কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে আশেপাশের সব গাছ-পালা, তরুলতা, মানুষ, এমনকি নিজেকেও। আর কয়েকদিন আগেও কি আমি এমন ছিলাম? কয়েকদিন পরে কি আমি থাকবো? কয়েকদিন পরে কি আমি ভুলতে পারবো এই মহামারির বিষয়টা? তা আমার মোটেও জানা নেই। আর কয়েকদিন পর কি আমি বলতে পারব, আমরা এই ভাবে জীবন যাপন করিনি, আমরা ছুটে চলেছি এ প্রান্ত থেকে প্রান্তে, আমরা ছুটে চলেছি কাজের জন্য এখান থেকে সেখানে, আমরা ছুটে চলেছিলাম খাবার কেনার জন্য, আমরা ছুটে চলেছিলাম আমাদের স্বপ্নের রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য, আমরা ছুটে চলেছিলাম আমাদের জীবনের সমস্ত সহজ পথ আরো সহজতর করার জন্য।
আর কয়েকদিন পর কি আমরা বলতে পারব আমাদের জীবনে এই মহামারী কেড়ে নিয়েছে অনেক সুখ দুঃখ, হাজার হাজার প্রাণ, এনে দিয়েছিল হাজার হাজার পরিবারে কান্নার রোল? সকালে যখন ঘুম থেকে উঠে টেলিভিশনের খবর দেখতে বসি – আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা, লাশের পরে লাশ এর ছবি। ভেতরটা এমনিতেই নাড়া দিয়ে যায়, ভেতর বাড়ি জুড়ে ক্রন্দন শুরু হয়, তারপরে আবার বন্ধ করে দিই টেলিভিশন। বুকের বা পাশে ব্যথা করে চিন চিন করে – এ কেমন এক দুঃসময় পার করছি আমরা। আজ আমরা নিজেদের জন্য নিজেরাই মৃত্যুর কারণ, নিজেরাই তিল তিল করে এগিয়ে যাই মৃত্যুর দিকে, অন্যদেরকেও নিয়ে যাই আমাদেরই পথে, সেটা আমাদের অপারগতা যখন আমরা মৃত্যুপুরীতে পৌঁছাব – তখন আমার কারনে যারা মৃত্যুবরণ করেছিল, তারা ঘিরে ধরবে আমাকে, হাজারো প্রশ্নবানে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমি তখন অসহায়ের মত শুধু তাকিয়ে থাকব যেমনটা এখন। আছি বেঁচে আছি এখন। যদিও জানি মৃত্যু অবধারিত, আমাদের সকলকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, এর চেয়ে আর কোন বাস্তবতা নেই, এর চেয়ে চরম আর কোন বাস্তবতা নেই যে আমাদের নিজেদের প্রতি নিজেদের অবিচারের ফলে লাশের পর লাশের স্তুপ দেখতে হবে। আমাদের সেই খেয়াল নেই, আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য, আমাদের পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের কতটা সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত কিন্তু আমাদের মত মানুষেরা যে পরিবারে বেড়ে উঠেছি সেই মধ্যবিত্ত পরিবারের দুবেলা খাবারের জন্য, পরিবারের মানুষদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় অসহায়ের মত, আমরা হাত পাততে পারিনা।
আমাদের কথা দূরেই থাক, যারা অসহায়, যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কাছে খাবার পৌঁছে না কিছু অসাধু মানুষদের জন্য। তারা পূর্বেকার নির্বাচনের পর সুস্থ সমাজের দরিদ্র মানুষদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল, ডাল, তেল, নুন,টিন বিভিন্ন ভাতা হস্তগত করে তারা নিজেদের বিত্তবান করে তুলেছিল কিন্তু এই সময় যারা ঘর থেকে বেরোতে পারছে না, বলতে পারলেও খালি হাতে ঘরে ফেরে, ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে ঘুমোতে যায় – তাদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল, ডাল, তেল, নুন ইত্যাদি চলে যায় সেই সব মানুষদের গুদামঘরে অথচ তারা মৃত্যুকে সত্য জেনেও কোনরূপ চিন্তাভাবনা নিজেদের মধ্যে জাগ্রত করে না। তাদের ভয় নেই মৃত্যুতে, যেন তারা জেনে গেছে – এই মহামারিতে তাদের কিচ্ছুটি আসবে যাবে না, তাদের কিছুতেই কিছু করতে পারবে না। তারা নিজেদের অজর, অমর, অক্ষয় মনে করি বেঁচে থাকে। তারা ক্রূর হাসি হাসে যখন ১০ জন মিলে এক মুঠো চাল মানুষদের প্রাণী হিসেবে দেয়, যখন একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টিভি মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়ায় তাদের ছবি দেখে পরিবারবর্গকে সাথে নিয়ে আর স্বস্তির হাসি হাসে। তারা এটাও বুঝতে পারো না এ তাদের কোন হাসি নয় – এ হাসি অমানুষের এ হাসি, অন্য কোন গ্রহের, অন্য প্রাণীর কারণ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের গ্রহের প্রাণীরাও এতটা নির্মম নয়, কঠোর নয়, মমতাহীন নয়। ওরা ছিনিয়ে নিতে জানে না একে অন্যের মুখের গ্রাস, এরা ছিনিয়ে নিতে জানে না মানুষের প্রাপ্য জিনিস
আমি কখনোই এইসব লোকেদের জন্তু-জানোয়ার বলে আখ্যায়িত করব না। আমি জানিনা আমি আর কত দিন বেঁচে থাকব, কতক্ষণ বেঁচে থাকব, কত মুহূর্ত বেঁচে থাকব, আমি পারিনা, আমি অক্ষম, আমি কাউকে এক বেলা খাবার ও জুটাতে পারিনা, আমি পারিনা ওদের মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে দিতে, আমি পারিনা নিজের অপারগতায় এবং এর জন্য নিজের উপর ঘেন্না বোধ হয়। যখন টিভির স্ক্রল নিউজে দেখলাম, আমাদের দেশের মানুষেরা তথাপি আমরা যদি এভাবেই চলতে থাকি, ন্যূনতম দুই মিলিয়নের বেশি লোক মৃত্যুবরণ করতে পারি। আমি ভয় পেয়ে যাই, আমরা ভয় পেয়েছি, আমাদের ভেতর কাঁপতে থাকে, হাতে ভাতের লোকমা নিয়ে যখন গলধঃকরণ করতে যাই- তখনো ভাবি, এই লোকমায়, এই হাতে করোনা ভাইরাস বিদ্যমান নয়তো! উপস্থিত নয়তো! আমি যখন পানি পান করি আমার আলাদা বোতলে – ক্যাপ এ হাত দেওয়ার সময় ভাবি, এখানে নেইতো! আমি এটাও ভাবি, বারবার হাতে হ্যান্ড রাব দিয়ে পরিষ্কার করার পর থেকে যাচ্ছে না তো! আমি আমার পরিবারকে বিপদগ্রস্থ করছি নাতো! বারবার হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধরে ভাবতে থাকি, এর চেয়ে বড় সংগ্রাম এর পূর্বে কোথাও কি হয়েছিল? প্রতিটা নিঃশ্বাসে, প্রতিটা পদে, প্রতিটা ক্ষণে ভাবতে থাকি – আমরা কি কখনো উত্তরণ করতে পারব? বেঁচে ওঠে আবার আমাদের কাজে ফিরে ফিরে যেতে পারবো? আমার উপর যে দু – একটি প্রাণ নির্ভরশীল তাদের মুখে অন্ন তুলে দেবার জন্য কাজে ফিরতে পারবো তো? নিয়তি আমার! ভয় হয়, প্রচন্ড ভয়, বেঁচে থাকার ভয়, মৃত্যুর ভয়। আহ! পৃথিবী, তোমার সারা শরীর আজ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে এই ভাইরাস, স্রষ্টা আমাদের রক্ষা করবেন আর সেই বিশ্বাস নিয়ে প্রতিক্ষণ, প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত বেঁচে থাকি। এই বিশ্বাস করে, এইতো মাত্র আর কটা দিন! আমরা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাব, আমরা আবার উদ্যম নিয়ে কাজে ফিরব, আমরা আবার রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বহুদূর দূর বহুদূরে যাব। আমরা বিশ্বাস করি, আমরা এটাই বিশ্বাস করি, আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে আমার সাথে পরিচিত-অপরিচিত এমন হাজারো মানুষ রয়েছে, অগুনতি মানুষ রয়েছে যাদের কষ্ট দিয়েছি কিন্তু তাদের কাছে ক্ষমা চাইবার কোন সুযোগ পাইনি। এমন অগুনতি মানুষ রয়েছে, যাদের সাথে আমি রূঢ় ব্যবহার করেছি, তাদের কাছেও তো আমার ক্ষমা চাওয়া হয়নি।
এমন অনেক বন্ধুবান্ধব, ভাই বোন, চেনা অচেনা, প্রিয় অপ্রিয় অনেকেই রয়েছেন যাদের কাছ থেকে প্রয়োজনে বিপদগ্রস্ত হয়ে ঋণ করেছি। আমি জানিনা তাদের ঋণ কখনো শোধ করতে পারব কিনা। এটাই ভাবি, যদি অযাচিত, আচমকাই আমি চলে যাই – তোমরা কি আমায় ক্ষমা করবে না? এমন অনেকেই আছে, রাস্তাঘাটে যাদের কখনো দেখিনি। তেমন মানুষ ও আছে। আমার কাছের মানুষ, যাদের সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা না পেলে আমি বেঁচে থাকতাম না। এমনও মানুষ আছে, যাদের আমি কখনো দেখিনি, হয়তো আর কখনো দেখবো না – তাদের সাথেও আমি জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে, অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি জানিনা তাদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে যেতে পারবো কিনা। আমি এটাও জানি, যারা মানুষ – তারা কখনোই এভাবে এত ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে, পাহাড় সম সেই সকল মানুষদের কষ্ট নিয়ে কেউ মরতে চায় না। যদিও মৃত্যুই চরম সত্য। একটা জিনিস আমার উপলব্ধিতে এসেছে যে, এই সময়টায় আমাদের ভেতর মানবিকতা জেগে উঠেছে, সহমর্মিতা জেগে উঠেছে, মনুষত্ব জেগে উঠেছে, একে অন্যের প্রতি ভালবাসা জেগে উঠেছে, অনাহারী মানুষদের প্রতি আমাদের কষ্ট ভেতরে উপলব্ধ হচ্ছে কিন্তু এই ভালোবাসা মানবিকতা উপলব্ধি আমাদের ভেতরে চিরন্তন হোক।
উপরে এতগুলো কথার মধ্যে আমি আমার মা-বাবাকে একবারও টানিনি কারণ আমি জানি পৃথিবীতে আর কেউ না হোক, আমার এই সমস্যাটা কিংবা এই পৃথিবীর আর যতই মা-বাবা আছেন তাদের সন্তানদের পাশে থাকবেন এই বিশ্বাস করে যে,আমার সন্তান! আমি মা-বাবাকে মহামানবদের কাতারে রেখে দিয়েছি কারণ সত্যিই আমাদের বাবা মায়েরা সাধারণ কোনো মানুষ নন আর সবচেয়ে বড় কথা হলো কি, আমাদের নিজেদের আমাদের মা বাবার উপর শ্রদ্ধাশীল, নম্র এবং দায়িত্বশীল হতে হবে, যাতে তারা এই দুঃসময়ে কোথাও সহজেই বিনা কারণে না বের হয়,আমরা প্রয়োজনে তাদের জন্য,তথাপি সবার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ পত্র ঘরে এনে রাখবো। সৃষ্টিকর্তা, তোমার প্রতি আমাদের মতো সন্তানদের একটাই চাওয়া – আমাদের মা – বাবাকে সুস্থ রেখ, নইলে আমরা কষ্ট পেলে, কাঁদলে কার আঁচলে মাথা ঢুকাবো, চোখ মুছবো, বলবো – আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো মা, আমি একটু কাঁদলে কার বুকের জমিনে মাথা রেখে বলবো – আমাকে জড়িয়ে ধরো বাবা! আমাদের তাড়া করে চলেছে মৃত্যুদূত, আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি। নিজেদের ভেতরবাড়িতে আমাদেরকে এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে, আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। আমরা আবার একসাথে কাজ করতে চাই, আমরা আবার সাপ্তাহিক ছুটি, উৎসবের ছুটি পরিবারের সাথে কাটাতে চাই, আমরা আবারও বন্ধুদের সাথে খুনসুটি করতে চাই, আমরা আবার আড্ডায় মেতে চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়িয়ে হাসতে হাসতে অনেক অনেক না বলা কথা, অজানা কথা শুনতে চাই – বলতে চাই, আমরা আর কয়েকটা দিন সাবধানে না হয় থাকি,না হয় মেনে নিতে হবে এই করুণ পরিস্থিতি।
আমরা জানি না, আমরা কিছুতেই জানিনা, আমরা জানব না কখনোই, জানব না আমরা কি আদৌ এই দুই মিলিয়ন সম্ভাব্য মৃত্যুর মিছিলে নিজেরা নিজেদেরকে সামিল করব কিনা! সুস্থ থাকি, নিরাপদে থাকি, সুস্থ রাখি, নিরাপদ রাখি।