গল্প: অসমাপ্ত ভালোবাসা


হাসু ছেলেটা অন্য আট দশটা ছেলেদের মতো না। অন্যদের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই এমন। ছোট বেলায় যখন বাবা-মা তার ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতো। তখন সে নিজ ইচ্ছায় স্কুলে চলে যেত। হাসুর বন্ধুবান্ধব এর অভাব ছিল না। কিন্তু হাসুর বান্ধুবী ছিলনা। বান্ধুবী ছিলনা বলতে সে মেয়েদের সাথে মিশতো না। মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারতো না। যার কারনে মেয়ে বন্ধু নেই। তার এমন স্বভাব দেখে অনেকেই তাকে লাজুক ছেলে নামেও ডাকতো। হাসু কখনো কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করতো না এবং প্রতিদিনের পড়া পরে স্কুলে যেত । যার কারনে সকল শিক্ষক/শিক্ষিকার ভালোবাসার পাত্র ছিল হাসু। দেখতে দেখতে ৫টা বছর পার হয়ে যায়। হাসু সমাপনী পরীক্ষা দেয়। এবং পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট ডিভিশন পায়। কিন্তু সে খুশি হতে পারেনা। কারন তাকে এখন এই বিদ্যালয় ছাড়তে হবে। তার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষিকা শারমিন সুলতানা কে ছেড়ে যেতে হবে। যে শিক্ষিকা তাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতো তাকে ছেড়ে যেতেই হাসুর খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। তাকে তো অন্যকোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যেতেই হবে। সবচেয়ে প্রিয় ম্যাম কে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট বুকে নিয়ে হাসু চলে গেল…
হাসু মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়। দু থেকে তিন মাসের মধ্যে হাসুর অনেক বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু পূর্বের মতই মেয়ে বন্ধু নেই। মেয়ে বন্ধু বানাতে চাইলে তো মেয়েদের সাথে কথা বলতে হবে। তাদের সাথে মিশতে হবে। কিন্তু সেতো কোনো মেয়ের সাথেই কথা বলেনা। যদি কোনো মেয়েও নিজ ইচ্ছায় এসে কথা বলে তো হাসু তখন মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলে। এমন অবস্থা দেখে কোনো মেয়েই তার সাথে কথা বলতে আসেনা।
দেখতে দেখতে মাধ্যমিক স্কুলে দুই বছর পার হয়ে যায়। তৃতীয় বছরের শেষে অষ্টম শ্রেণীতে বোর্ড পরীক্ষা দেয় হাসু। রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই হয়। পয়েন্ট আসে ৪.৮৩। নবম শ্রেণিতে উঠে সাইন্স নিয়ে পড়া শুরু করে।
হাসুর যখন নবম শ্রেনীতে চার মাস। ঠিক তখনি প্রেম-ভালোবাসার ভূত এসে মাথায় চরে বসে। প্রথমে এমনি এমনি আসে নাই। বন্ধু বান্ধব এক প্রকার জোর করেই প্রেমের ভূত টা মাথায় চাপিয়ে দিয়েছিল। বন্ধুবান্ধব দুষ্টামি করে হাসুর অজান্তেই হাসুর নাম করে রাফসা নামের একটা মেয়ে কে প্রেমের প্রপোজাল দেয়। অথচ হাসু এই বিষয়ে কিছুই জানেনা।
যে ছেলেটা স্কুলে গিয়ে পি টি শেষ করে সেই যে ক্লাস রুমে ঢুকে বিশেষ কোনো কারন ছাড়া আর রুম থেকে বের হয় না। যে স্কুলের কোনো মেয়ের সাথেই কথা বলে না। এমন একটা ছেলের প্রেমের প্রপোজাল পেয়ে মেয়েটা একটু অবাক হয়েছে। মেয়েটা বিশ্বাস করতে পারছিলনা যে, হাসু মেয়েটাকে সত্যি প্রপোজ করেছে। মেয়েটা তার সন্দেহ দূর করার জন্য হাসুর সাথে সরাসরি কথা বলে।
রাফসা: আপনি যে আমাকে পছন্দ করেন, সেটা আপনি নিজেই আমাকে বলতে পাড়তেন।
হাসু অবাক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। আর মনে মনে ভাবছে; মেয়েটা কি মানুষিক রুগী? কিন্তু.. দেখে তো তা মনে হচ্ছেনা। তবে.. এমন কথাই বা বলছে কেন?
রাফসা: এই যে অমন করে তাকিয়ে থাকলে আমার বুঝি লজ্জা করে না।
হাসু: আপু তুমি এসব কি বলছো? তুমি তো আমার ছোট বোনের মতো।
রাফসা: কি বলেন? তাহলে যে আপনার বন্ধু আমাকে বললো আপনি নাকি আমাকে খুব পছন্দ করেন আর ভালোবাসেন।
হাসু এবার বিষয় টা পরিষ্কার বুঝতে পাড়ে যে, তার বন্ধু দুষ্টামি করেই এই কাজ করেছে। আর কে এই কাজ কে করছে সেটাও চিহ্নিত করে ফেলে।
যে ছেলেটা এমনিতেই মেয়েদের সাথে ঠিক করে কথা বলতে পারেনা তার উপর এমন একটা পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে তা কে জানতো। তার পরেও অনেক কষ্টেসৃষ্টে মেয়েটাকে বুঝায় যে এটা তার বন্ধুর দুষ্টামি মাত্র। সে এই বিষয়ে কিছুই জানেনা। মেয়েটাও হাসুর কথা বুঝতে পারে। এবং মেয়েটা তার কমনরুমে চলে যায়। হাসুও তার ক্লাসরুমে চলে যায়। তারপর…
হাসু: রাসু উ উ উ!
রাসু: কি হয়েছে বন্ধু? এমন করে ডাকছিস কেন?
হাসু: কি হয়েছে তুমি জানোনা, তাই না?? একটু রাগান্বিত হয়ে; তুই আমার নামে মানুষ কে আজেবাজে কথা বলেছিস কেন?
হাসুর রাগান্বিত হওয়া দেখে অন্য বন্ধুরা এসে জিজ্ঞাস করেছে, কি হয়েছে হাসু? রাসুর সাথে চিল্লাচিল্লি করছিস কেন?
রাসু: আমিও তো সেটাই বলছি।
হাসু: রাসু তুই আমার নামে রাফসা কে কি বলেছিস।
রাসু: ওহ এই কথা। না, তেমন কিছু তো বলি নাই। শুধু বলেছি তুই রাফসা কে পছন্দ করিস আর খুব ভালোবাসিস।
হাসু: রাসুর কথা শুনেছিস তোরা? এবার তোরাই বল কেমন লাগে! আমি কি এমন কিছু করেছি বা বলেছি যে ও আমার নামে রাফসা মেয়েটা কে প্রেমের প্রপোজাল দিল।
হাসুর বন্ধুরা উল্টো রাসুর পক্ষ নিয়ে বলে; রাসু তো তেমন কিছু করে নাই যে, তুই এতো রেগে যাচ্ছিস। বন্ধু হিসেবে তোকে একটু বেশি ভালোবাসে তাই এই কাজ করেছে। দেখ যেখানে কমবেশি সবাই রিলেশন করছে সেখানে তুই ই বা রিলেশন করবি না কেন? বিভিন্ন ভাবে হাসুকে বুঝায় তার বন্ধুরা। হাসু এক পর্যায় শান্ত হয়ে যায়। হাসু তার বন্ধুদের কথা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। তার কি আসলেই একটা প্রেম করা জরুরী। প্রেম না করলে কি জীবনের এক অধ্যায় বাকী থেকে যায়। এমন নানা প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতোমধ্যে ক্লাসে স্যার চলে আসে। স্যার ক্লাস নিচ্ছে আর একটা বিষয় লক্ষ্য করছে আজ যেন হাসুর ক্লাসে মন নেই। হাসু মনে মনে কি যেন ভাবছে। স্যার এবার বলেই উঠলো ;
স্যার: হাসু, আর ইউ ওকে? তুমি ঠিক আছ তো?
হাসু: ইয়েস স্যার, আই এম ওকে। আমি ঠিক আছি।
স্যার: তোমাকে আজ কেমন জানি অন্যমনস্ক লাগছে।
হাসু: না স্যার, একটু মাথা ব্যথা করছে তাই। তবে ঠিক হয়ে যাবে।
স্যার: ওকে, আমরা আমাদের পড়ায় ফিরে আসি তাহলে।
স্যার পড়াচ্ছে। স্যার কিছু বুঝতে না পারলেও হাসুর বন্ধুরা তার অন্যমনস্ক হওয়ার কারন টা ঠিকই বুঝতে পাড়ে। তার বন্ধুরা বুঝতে পাড়ে যে, তারা যে ওষুধ দিয়েছে তাতে কাজ হচ্ছে।
হাসু ভাবতে ভাবতে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে যে, সে একটা রিলেশন করবে। হাসু মেয়েদের দিকে ঠিক করে তাকাতো না। কিন্তু হঠাৎ তার বন্ধুরা খেয়াল করে যে, হাসু লুকিয়ে লুকিয়ে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর মেয়েটা যখন হাসুর দিকে তাকায় তখন সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। বন্ধুরা বিষয়টা আমলে নিয়ে নেয়। এবার রাসু আর একা না। বন্ধুদের সাথে নিয়ে তাদের বান্ধুবী সুস্মিতার কাছে যায়। এবং সুস্মিতা কে বিষয় টা বুঝিয়ে বলে। সুস্মিতা বিষয় টা বুঝতে পেড়ে হাসুর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নেয়। হাসুও সুস্মিতা কে অনুরোধ করেই বলে সোহা নামের মেয়েটা কে তার হয়ে প্রপোজাল দিতে। সুস্মিতা হাসুকে বুঝায়;
সুস্মিতা: দেখ এইসব বিষয়ে বেশি মানুষ না জানানোই ভালো। আমি বলতেই পাড়ি। কিন্তু বলার পড়ে এটা অন্য পর্যায় যেতে পারে। কেননা এটা একটা গোপন বিষয়। আর মেয়েরা এটা গোপন রাখতেই পছন্দ করে।
হাসু: তাহলে কি আমাকেই বলতে হবে। কিন্তু আমি কেমন তুই তো জানিস। মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে আমার পা কাঁপে।
সুস্মিতা: ওরে আমার লজ্জাবতী রে, লজ্জা টা একটু কমা আর একটু সাহস সঞ্চয় কর। এতো ভীতু হলে চলে? সাহস করে বলে দেখ কাজ হয়ে যাবে।
হাসু: তুই বলছিস কাজ হবে?
সুস্মিতা: হ্যাঁ, কাজ হবে। তুই বলেই দেখ না।
হাসু: ধন্যবাদ বন্ধু সুস্মিতা।
সুস্মিতার কথামতো টিফিন টাইমে হাসু তার ক্লোজ ফ্রেন্ড রাসু কে সাথে নিয়ে সোহার বাড়ির রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। কারন সোহার বাড়িটা স্কুলের কাছে হওয়ায় সে টিফিন নিয়ে আসে না বাড়ি গিয়েই টিফিন করে আসে। আজও টিফিন করতে বাড়ি যাবে। তাই আগে থেকেই হাসু তার ক্লোজ ফ্রেন্ড রাসুর সাথে রিহার্সাল করছে। যে সোহা কে কি বলবে। কেমন করে বলবে যে তাকে সে পছন্দ করে আর ভালোবাসে। হাসু তার বন্ধুর সাথে রিহার্সাল করতেই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল। তাই রাসু মনে মনে ভাবছে হাসু মেয়েটার সামনে কথা বলতে পাড়বে কি? রাসু তার বন্ধুর নার্ভাস দূর করার জন্য বিভিন্নভাবে সাহস দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সোহা তার বান্ধুবীদের সাথে নিয়ে টিফিনে বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু হাসু একটু বেশিই নার্ভাস। কারন সে ভেবেছিল মেয়েটা একা যাবে। তখন বলবে সে ওকে অনেক পছন্দ করে ও ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটা তার বান্ধবীদের সাথে যাচ্ছে। হাসু কিছুই বলছে না। শুধু তাকিয়ে আছে। মেয়েটা তার সামনে দিয়ে বান্ধুবীদের নিয়ে চলে যাচ্ছে। অথচ হাসু কিছুই বলছে না। তখন…
রাসু: দোস্ত মেয়েটা চলে গেল তো। ডাক না। আরে চলে গেল তো।
হাসু: দোস্ত ভয় লাগে যে। কি করে বলবো।
রাসু: থাক তুই তোর ভয় নিয়ে আমি গেলাম। তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
এই বলে রাসু চলে গেল। হাসুর আর সাহস করে বলা হল না যে, সে সোহাকে পছন্দ করে আর ভালোবাসে। তার বন্ধুরাও তাকে আর এই বিষয়ে কোনো কথা বলে না। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে যায়। কিন্তু তাও হাসুর সাহস হয় না ভালোবাসি তোমাকে কথা টা বলার।
হঠাৎ একদিন মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়। তাই সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। হাসু তখন মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পরে। ঠিকমত স্কুলে আসেনা পড়েনা।
এমন করতে করতে এসএসসি পরীক্ষা চলে আসে। হাসু পরীক্ষা দেয়। রেজাল্ট খুব একটা ভালো আসে না। A- (3.89) পয়েন্ট আসে।
হাসু হাইস্কুল লাইফ পার করে কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু সে পূর্বের মতই থেকে যায়। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলেও তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেনা। আর মেয়েটাও বুঝতে পারেনা যে ছেলেটা তাকে ভালোবাসে। দু’দিন পরে যখন দেখে মেয়েটা অন্য ছেলের সাথে রিলেশনে জড়াচ্ছে বা বিয়ে হয়ে শশুর বাড়ি চলে যাচ্ছে। তখন হাসু খুব কষ্ট পায়।
হাসু কলেজ লাইফও পার করে ফেলেছে। কিন্তু হাসুর প্রেম টা এখনো সমাপ্ত হল না অসমাপ্তই রয়ে গেল। এখনো তার পছন্দের মানুষ টাকে সাহস করে বলতে পাড়ে না আমি তোমাকে পছন্দ করি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই কথা টা বলার সাহস আজও তার হয়ে ওঠে নাই। কবে তার সেই সাহস হবে তা কেউ জানেনা। তবে হাসু সাহস সঞ্চয় করছে। একদিন না একদিন তার সাহস পরিপূর্ণ হবেই। আর সেই দিন হাসু সাহস করে বলবেই; আমি তোমাকে পছন্দ করি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে আমার জীবন সঙ্গী করতে চাই।
বিঃ দ্রঃ ব্যবহৃত নামগুলো ছন্দ নাম মাত্র।
লেখক:-
এম ডি হাফিজুর রহমান।
কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
ইমেইল:- hafiz321242@gmail.com