6:23 AM, 21 October, 2025

সম্রাটের ইশারায় চলতো যুবলীগ

samrat

বিস্ময়করভাবে উত্থান হয় গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের। শুধু ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজিই নয়, নির্যাতনের মাধ্যমেও অর্থ আদায় করতেন তিনি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ছিলো বিস্তর অভিযোগ। বছরের পর বছর ধরে তিনি চালিয়ে গেছেন নিজের এসব অপকর্ম। তবুও তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি।

সম্রাট তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বহু ব্যবসায়ীকে তার কার্যালয়ে তুলে নিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেছেন। এরকম অসংখ্য অভিযোগ থাকার পরও সম্রাটের নামে কেউ কখনো মামলা দেওয়ার সাহস পাননি বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দেশ রূপান্তর।

প্রতিবেদনে বলাহয়, ক্যাসিনো ব্যবসার পাশাপাশি সম্রাট চাঁদাবাজিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা পর্যন্ত যে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে জাকাত এবং দান করেন সে প্রতিষ্ঠানের কাছেও চাঁদা দাবি করে সম্রাট বাহিনী। কাকরাইলে আঞ্জুমানের ভবন তৈরির সময় ১০ কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন সম্রাট ও তার সঙ্গপাঙ্গোরা। এ খবর গণমাধ্যমে আসলে প্রধানমন্ত্রী তার ওপর ভয়ংকর ক্ষুব্ধ হন।

পুলিশ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের কাছে থেকে জানা যায়, যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মতো একটি বড় ইউনিটের সভাপতি হওয়ায় সম্রাট সবসময়ই বিশাল বাহিনী নিয়ে চলতেন। কাকরাইলের অফিসে তার অবস্থানকালীন সময় কয়েকশ নেতাকর্মী সার্বক্ষণিক তাকে ঘিরে রাখত। অফিস থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে তাকে প্রটোকল দিত শতাধিক নেতাকর্মী।

নরসিংদীর জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী জানান, তার কোনো একটি দুর্বল মুহূর্তের ভিডিও সম্রাট ও তার লোকজনের কাছে চলে যায়। ওই ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয়। ওই ভিডিওর ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ নিত সম্রাটের লোকজন।

বড় বড় ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য ফোন করতেন সম্রাট। তার দাবি অনুযায়ীই তাকে চাঁদা দিতে হতো। অফিসে বসেই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন টেন্ডারসহ বিভিন্ন ঠিকাদারি।

ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব সাহেবনগর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন তার বাবা ফয়েজ আহমেদ। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকে না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায়ই সম্রাটের বেড়ে ওঠা। ১৯৯৬ সালের দিকে ঢাকা মহানগরীর ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ওই সময় থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। ওই ওয়ার্ডের সভাপতি লুৎফুর রহমানকে মারধরের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় সম্রাটসহ তিনজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হলেও সে সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়িত হয়নি। পরে রমনা থানা যুবলীগের আহ্বায়ক মনোনীত হন।

২০০৩ সালে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন সম্রাট। সে সময় দক্ষিণের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালের কাউন্সিলে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নির্বাচিত হন সম্রাট। দক্ষিণ যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা রিয়াজুল ইসলাম মিল্কী নিহত হওয়ার পর তার সাম্রাজ্য দখল করে সম্রাটের শনৈ শনৈ উন্নতি হয়। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও চান সম্রাট। কিন্তু এ আসনটি মহাজোটের প্রার্থী রাশেদ খান মেননকে দেওয়ায় তিনি মনোনয়ন পাননি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধও ছিলেন সম্রাট।

রাজধানীর রমনা, মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলাকায় অপরাধজগতে একক আধিপত্য বিস্তার করেন সম্রাট। ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে তিনি অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ দুই সহচর হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ এবং যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। যুবলীগ নামধারী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের কাছ থেকেও অবৈধ আয়ের ভাগ নিতেন সম্রাট। আর সম্রাটকে ব্যবহার করে টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন শামীম। টাকা দিয়ে প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলের সবকিছু ম্যানেজ করতেন তিনি এবং তার সহযোগীরা।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, ঢাকায় দলীয় সমাবেশগুলো সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো সম্রাটের। টাকা ও জনবল সরবরাহ দিতেন তিনি। এসবের মাধ্যমে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। তিনি সম্রাটকে ‘শ্রেষ্ঠ সংগঠক’ ঘোষণা করেন। ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যান ও হারুন রশিদ সাধারণ সম্পাদক হলেও যুবলীগের সবকিছু চলত সম্রাটের ইচ্ছে অনুযায়ী।

মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর সম্রাট কাকরাইলে রাজমণি সিনেমা হলের উল্টো দিকে বিশাল এক ভবনের পুরোটাজুড়ে অফিস শুরু করেন। সাংগঠনিক কাজের কথা বলা হলেও এখানে বসেই সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এখানে থাকত তার কর্মী বাহিনী ও অপকর্মের সঙ্গীদের আনাগোনা।

সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী ঢাকায় তার ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই রাশেদ চৌধুরীও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। সম্রাটের মা বড় ছেলের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পরই সম্রাটের পরিবারের সবাই গা ঢাকা দেন। সম্রাট আগে থাকতেন মহাখালীর বাসায়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর তিনি ওই বাসায় যান না। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরীও বিষয়টি স্বীকার করেন।
সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ রাজধানীর জুয়াড়িদের কাছে বেশ পরিচিত নাম। সম্রাটের নেশা ও ‘পেশা’ ছিল জুয়া খেলা। তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রীও দাবি করেছেন জুয়া খেলা ছিল সম্রাটের নেশা।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের মতে, জুয়া খেলার জন্য প্রতি মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে কাটাতেন সম্রাট। যাওয়ার সময় সেখানে ডলারের বস্তা নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। কিন্তু সেখানেও সম্রাট ‘ভিআইপি জুয়াড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পান। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হতো বিলাসবহুল ‘লিমুজিন’ গাড়িতে করে। সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে গেলে সম্রাটের নিয়মিত সঙ্গী হতেন যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, মমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও জুয়াড়ি খোরশেদ আলম।

এদের মধ্যে সাঈদ কমিশনারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি ১০ বছর আগে ঢাকায় গাড়ির তেল চুরির ব্যবসা করতেন তিনি। আর কাউন্সিলর হওয়ার পর হেলিকপ্টারে চড়ে এলাকায় যান এই সাঈদ। এমপি হওয়ার জন্য প্রচারও চালাচ্ছিলেন এলাকায়। মতিঝিল এলাকার তিনটি ক্লাবের সভাপতি তিনি।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ সেপ্টেম্বর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি যুবলীগের কয়েকজন নেতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে।

এরপরই র‌্যাবের নেতৃত্বে শুরু করে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। গত ১৮ সেপ্টেম্বর গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। তাকে গ্রেপ্তারের পরপরই মতিঝিলসহ রাজধানীর কয়েকটি অভিজাত ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোসামগ্রী জব্দ ও ক্লাব সিলগালা করে র‌্যাব-পুলিশ। খালেদ গ্রেপ্তারের সময় কাকরাইলের নিজ কার্যালয়ে সম্রাটকে ‘পাহারা’ দিয়ে রাখছিলো তার সঙ্গপাঙ্গোরা। পরে সেখান থেকে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। এ সময় কোনো কোনো গণমাধ্যমে সম্রাটকে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নেয়া অথবা নজরদারিতে রাখার সংবাদও প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে গত ২৪ সেপ্টেম্বর সম্রাটের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও লেনদেন স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর সম্রাটের দেশত্যাগের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।