শান্তির ধর্ম ইসলাম

মো. স্বপন হোসেন, আল কোরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অধ্যয়নরত, মঙ্গলবাড়ীয়া কামিল মাদরাসা, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।
‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটি মুসলিম জাতির মনের কথা এবং অতি সত্য ও বাস্তব কথা। তবে বহুল উচ্চারিত অনেক সত্য কথার মতো এ কথারও মর্ম ও বিস্তৃতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কারণ, সঠিক কথারও ভুল বা অসম্পূর্ণ অর্থ গ্রহণের সম্ভাবনা থাকে। কুরআন মাজীদে আল-কুরআনের তথা ইসলামের শিক্ষা ও বিধানের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ قَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلُنَا یُبَیِّنُ لَكُمْ كَثِیْرًا مِّمَّا كُنْتُمْ تُخْفُوْنَ مِنَ الْكِتٰبِ وَ یَعْفُوْا عَنْ كَثِیْرٍ قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ اللهِ نُوْرٌ وَّ كِتٰبٌ مُّبِیْنٌ یَّهْدِیْ بِهِ اللهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهٗ سُبُلَ السَّلٰمِ وَ یُخْرِجُهُمْ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوْرِ بِاِذْنِهٖ وَ یَهْدِیْهِمْ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ.
তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে চায় এ দ্বারা তিনি তাদের শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং অন্ধকারসমূহ থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন নিজ ইচ্ছায়। আর তাদের পথ দেখান সরল পথ। সূরা মায়েদা (৫) : ১৫-১৬
এ আয়াতে ‘সালাম’ শব্দ আছে। সাধারণত ‘সালাম’ শব্দের অর্থ করা হয় ‘শান্তি’। এ অর্থ ভুল নয়, তবে সূক্ষ্ম অর্থ হচ্ছে ‘মুক্তি’। বিপদ ও অশান্তি থেকে মুক্তিই তো শান্তির বড় উপায়। ইসলাম মানুষকে বিপদ ও অশান্তি থেকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করে। তাই ইসলাম শান্তির ধর্ম।
ইসলামের কিতাব আল-কুরআন মানুষকে নাজাতের পথ দেখায়। প্রথমত আখিরাতের মহা বিপদ থেকে নাজাতের। ইসলামী আকীদার এক প্রধান বিষয় আখিরাতে ঈমান এবং ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার গোটা ব্যবস্থাটিই তাক্বওয়া (খোদাভীতি) ও ঈমান বিল আখিরাহ (আখিরাতের উপর ঈমান)-এর উপর ভিত্তিশীল। তেমনি ইসলামী দাওয়াতের প্রধান অংশ আখিরাত ও আখিরাতের নাজাত। ইসলামের নবী, বিশ্ব মানবতার নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল আখিরাত এবং তাঁর গোটা জীবনের সফল সমুজ্জ্বল বিস্তৃত ও বিচিত্র দাওয়াতী কর্মতৎপরতার অন্তর্নিহিত ঐক্যের সূত্রটি ছিল আখিরাত। ইসলামের আকীদা-প্রসঙ্গ হোক বা ইবাদত, লেনদেন হোক বা সামাজিকতা, স্বভাব-চরিত্র হোক বা আচার-আচরণ, সৎকাজের আদেশ হোক বা অসৎকাজের নিষেধ। এককথায় মানবজীবনের সব বিষয়ে ইসলামের যে বিশ্বাস ও বিধান তা গ্রহণ ও অনুসরণের মূল প্রেরণা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের নাজাত। এ কারণে ইসলামের করণীয়-বর্জনীয় সকল বিষয়ের সাথে যে পরিভাষাগুলো জড়িত তা হচ্ছে ছওয়াব ও গুনাহ, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি। ইসলামের কোন শিক্ষাটি এমন যেখানে পাপ-পুণ্যের, জান্নাত-জাহান্নামের এবং আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির প্রসঙ্গ নেই?
ইসলামী দাওয়াতের শিরোনাম-বাক্য যদি হয় ‘আস্লিম তাস্লাম’ ‘ইসলাম কবুল কর নাজাত পাবে।’ তাহলে এই নাজাত প্রধানত আখিরাতের নাজাত। ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের অন্যতম উদ্দেশ্য যদি হয়- ‘ইন্নী নাযীরুল লাকুম বাইনা ইয়াদাই আযাবিন শাদীদ’ (আমি এক কঠিন আযাবের পূর্বে তোমাদের হুঁশিয়ারকারী।) তাহলে এই আযাব প্রধানত আখিরাতের আযাব। সুতরাং ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’- কথাটির প্রধান মর্মবাণী আখিরাতের নাজাত ও শান্তি। অর্থাৎ ইসলাম ঐ ধর্ম যা আখিরাতের নাজাত ও শান্তির পথ প্রদর্শন করে। বরং একমাত্র ইসলামই ঐ ধর্ম যার মাধ্যমে আখিরাতে নাজাত পাওয়া যাবে।
وَ مَنْ یَّبْتَغِ غَیْرَ الْاِسْلَامِ دِیْنًا فَلَنْ یُّقْبَلَ مِنْهُ وَ هُوَ فِی الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.
কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন কবুল করতে চাইলে তার নিকট থেকে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। সূরা আল ইমরান (৩) : ৮৫
এই মর্ম বিস্মৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ অর্থ অনুসারে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটিতে বিশ্বাসের দাবি, আখিরাতে নাজাতের যে পথ ইসলাম দেখায় সেই পথের পথিক হওয়া। সালামের শিক্ষা অনুযায়ী আপন আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত করা, আল্লাহর হক ও বান্দার হক সম্পর্কে জানা ও তা আদায় করা, সব রকমের গোনাহ ও পাপাচার থেকে এবং আল্লাহর হক ও বান্দার হক নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা। মৃত্যু পর্যন্ত ইসলাম-নির্দেশিত পথে থেকে আখিরাতের চিরস্থায়ী শান্তির উপযুক্ত হওয়া।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম কি শুধু আখেরাতের মুক্তির পথই প্রদর্শন করে? পার্থিব শান্তির উপায় নির্দেশ করে না? ইসলাম পার্থিব শান্তি ও কল্যাণের পথও নির্দেশ করে। আর এ হচ্ছে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটির বিস্তৃত মর্মের দ্বিতীয় অংশ। শুরুতে সূরা মায়েদার যে আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে তাতে ‘সুবুলাস সালাম’ (মুক্তির পথসমূহ) শব্দবন্ধে পার্থিব মুক্তিও শামিল। এক্ষেত্রেও ইসলাম ঐ অদ্বিতীয় ধর্ম যাতে মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রের এবং মানবজাতির সকল শ্রেণির যথার্থ শান্তি ও কল্যাণের পথনির্দেশ রয়েছে। এটা বোঝার জন্য ইসলামের এক একটি শিক্ষা ও বিধানের যথার্থতা নিয়ে নির্মোহ চিন্তা-ভাবনাই যথেষ্ট। তাহলে দেখা যাবে ইসলামের শিক্ষা ও বিধানের অনুসরণেই রয়েছে মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় জীবনের শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা ও প্রশান্তির নিশ্চয়তা।
কে না জানে শান্তি ও প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষের মন। মনে যদি শান্তি থাকে তাহলে গোটা সত্তায় শান্তি বিরাজ করে। আর মন যদি অশান্ত হয় মানবের গোটা সত্তা অশান্তিতে আক্রান্ত হয়। মনের শান্তির একমাত্র উপায় আল্লাহর স্মরণ, তাঁর প্রতি আস্থা ও সমর্পণ এবং জীবন ও জগতের সকল বিষয়ে তাঁর ফয়সালায় সন্তুষ্টি। এই সম্পদ যে পেয়েছে জীবনে তার দুঃখ-কষ্ট থাকতে পারে, উপায়-উপকরণের স্বল্পতাও থাকতে পারে কিন্তু অশান্তি থাকে না। কারণ মহান আল্লাহ তার হৃদয়কে পরিতুষ্টি ও পরিতৃপ্তি দ্বারা পূর্ণ করে দেন। আল্লাহর প্রতি আস্থার অবলম্বনে তাঁর হৃদয় থাকে ভারমুক্ত ও শঙ্কামুক্ত। পক্ষান্তরে এই সম্পদ যে পায়নি ভোগের সকল উপকরণের মাঝেও সে শান্তি খুঁজে পায় না। অশান্তির আগুনে দগ্ধ হতে থাকে। কারণ তুষ্টি ও আনন্দ, আস্থার অবলম্বন ও ভারমুক্ততা এবং বিবেকের দংশন থেকে মুক্তির মতো শান্তির উপকরণগুলো থেকে তার হৃদয়-মন বঞ্চিত থাকে। মনের এই ক্ষোভ, অতৃপ্তি ও হাহাকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার কর্ম ও আচরণে। তার শিক্ষাহীন হৃদয়ের ঔদ্ধত্য, হিংসা, কুটিলতা ও কপটতা একে একে বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং শুধু তাকেই নয়, তার আপনজন, প্রিয়জন, পাড়া-প্রতিবেশি, কর্তা-সহকর্মী অধীনস্ত সবাইকে সন্ত্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত করে তোলে। ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সত্য বলেছেন- ‘মানব-দেহে একটি মাংসপিন্ড রয়েছে। যখন তা শুদ্ধ হয় গোটা দেহ শুদ্ধ হয় আর যখন তা নষ্ট হয় গোটা দেহ নষ্ট হয়ে যায়। শোনো, তা হচ্ছে কলব (হৃদয়)।
সামষ্টিক জীবনের শান্তি নির্ভর করে পারস্পরিক অধিকার রক্ষা এবং একের অস্তিত্ব অন্যের জন্য অশান্তির কারণ না হওয়ার উপর। তাই ব্যক্তির পরিশুদ্ধি তথা মানবীয় সুকুমারবৃত্তির বিকাশ, উন্নত গুণাবলির উৎকর্ষ, মন্দ প্রবণতাসমূহের নিয়ন্ত্রণ, পরস্পরের হক ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা এবং উত্তম পরিশীলিত আচরণ-উচ্চারণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। আখলাক ও তাযকিয়া ইসলামী শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আখলাক তথা স্বভাব-চরিত্রের পরিশুদ্ধির সাথে ইসলামে অতি বিস্তৃতভাবে রয়েছে সামষ্টিক জীবনে পারস্পরিক কর্তব্য ও অধিকারের বর্ণনা ও শিক্ষা। তাই ‘আখলাক’ ও ‘মুআশারা’ ইসলামী শিক্ষা ও জীবন-ব্যবস্থার দুই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বর্তমান বিশ্বসভ্যতার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতটা অপরিহার্য পার্থিব জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ইসলামের ‘আখলাক’ ও ‘মুআশারা’র শিক্ষা তার চেয়েও বেশি অপরিহার্য। এই শিক্ষার চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই সূচিত হতে পারে সামষ্টিক জীবনের শান্তি ও স্বস্তি। সুতরাং ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’-এই বিশ্বাস ও উচ্চারণের দাবি, আল্লাহমুখিতা, আল্লাহর প্রতি আস্থা ও সমর্পণ, খোদাভীতি ও আখিরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতির মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর পাশাপাশি ইসলামী আখলাক ও মুআশারা তথা ইসলামী স্বভাব-চরিত্র ও সামষ্টিক জীবনের ইসলামী নীতি ও বিধানের চর্চা ও অনুশীলন।
এরপর শান্তির জন্য শুধু শিষ্টের ও শিষ্টতার লালনই যথেষ্ট নয়, দুষ্টের ও দুষ্টপ্রবণতার দমনও অপরিহার্য। তাই শান্তির ধর্ম ইসলামে রয়েছে হদ-কিসাস-তাযীরের মতো নানা বিধান। রয়েছে নাহি আনিল মুনকার ও জিহাদের বিধান। এগুলো ইসলামের স্বতন্ত্র ও বিস্তৃত অধ্যায়। রাষ্ট্রের ক্ষমতাশীলদের দায়িত্ব এসব বিধানের জ্ঞান যথাযথভাবে অর্জন করে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। এই অধ্যায়ের নীতি ও বিধানের সঠিক উপলব্ধি ও যথার্থ প্রয়োগ সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা এবং ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।
এমনিভাবে নাগরিকদের ফৌজদারী অপরাধের বিচারের পাশপাশি এটাও নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, ক্ষমতাবানগণ কর্তৃক যেন এমন কোনো অপরাধ সংঘটিত না হয়। হত্যা, গুপ্তহত্যা, গুম, খুনের মত অপরাধগুলো যেন কারো থেকেই সংঘটিত না হয়। সুতরাং ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’- এই বিশ্বাস ও উচ্চারণের এক দাবি, ইসলামের নাহি আনিল মুনকারের নীতি ও বিধানের যথার্থতা উপলব্ধি এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান অনুসারে এর চর্চা ও অনুশীলন।
এক কথায় ইসলাম বাস্তব অর্থে শান্তির ধর্ম। যে কেউ কোনো কিছুকে শান্তি মনে করে; ইসলামকে ঐ অর্থে শান্তির ধর্ম মনে করা ভুল। অন্যায় অনাচার, অশ্লীলতা, জুলুম-অবিচার হিংস্রতা ইত্যাদিকে কেউ যদি ‘শান্তি’ মনে করে তাহলে ইসলাম ঐ অর্থে শান্তির ধর্ম নয়। কারণ এগুলো ‘শান্তি’ নয়, নির্বিচার ইচ্ছা পূরণ মাত্র, যা দুনিয়া আখেরাতের চূড়ান্ত অশান্তির কারণ। মুমিনের প্রতি কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِی السِّلْمِ كَآفَّةً وَّ لَا تَتَّبِعُوْا خُطُوٰتِ الشَّیْطٰنِ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ.
হে মুমিনগণ! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। -সূরা বাকারা (২) : ২০৮
সুতরাং মুমিনের কর্তব্য, পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামে প্রবেশ করা এবং জীবনের সকল অঙ্গনে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও বিধানের চর্চা ও বিস্তারে ব্রতী হওয়া। তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের জীবনে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করবে এবং ইসলাম শান্তির ধর্ম কথাটির সত্যতা ও যথার্থতা বাস্তবরূপে প্রতিফলিত হবে।
“ইসলাম শান্তির ধর্ম” এ কথা কোরআন শরিফের কোথাও বলা আছে কি না, সে সম্পর্কে নিউইয়র্ক থেকে টেলিফোনে জানতে চেয়েছেন ইয়াসমিন। অনুলিখনে ছিলেন জহুরা সুলতানা। প্রশ্ন: আমার এক বোন আমাকে বললেন যে, ইসলাম তো বলে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’। কিন্তু কোরআন শরিফে কোথায় বলা হয়েছে ইসলাম শান্তির ধর্ম? এটা আমাকে বল। এই বিষয়টি সম্পর্কে একটু বলবেন? উত্তর: ইসলাম শব্দের অর্থই তো শান্তি। পবিত্র কোরআনের আল ইব্রাহিম সূরার ১৯ নম্বর আয়াতটি আপনি দেখতে পারেন, তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।’ ইসলাম শব্দের অর্থই হচ্ছে শান্তি, শান্তি এর মধ্যেই রয়েছে। এ ছাড়া কোরআনে কারিমের আরো একাধিক আয়াতের মধ্যে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা শান্তির মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করো (সূরা আল বাকারা)।’ অর্থাৎ ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করো। এখানে শান্তি শব্দ দিয়ে ইসলামকেই বোঝানো হয়েছে। কোরআনের বহু জায়গায় এ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক আয়াতের মধ্যে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা শান্তির কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ ইসলাম শান্তির ধর্ম, এটি প্রমাণিত সত্য বিষয়। এখানে দ্বিমত করার সামান্যতম সুযোগ নেই।
ইসলাম কি সত্যিই শান্তির ধর্ম? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আপনাকে ডিফাইন করতে হবে আপনি শান্তি দ্বারা কি বুঝান। যদি বুঝান যে, ইসলাম ধর্ম গ্রহনের মাধ্যমে কেউ শান্তি লাভ করে তাহলে অবশ্যই ইসলাম শান্তির ধর্ম।
কিন্তু যদি শান্তির ধর্ম দ্বারা এ কথা বুঝানো হয় যে, কাফিররা আমাদের নারী-শিশুদের হত্যা করবে, বোনদের ধর্ষণ করবে এবং উম্মাহর শিশুদের এতিম বানাবে কিন্তু আমরা চুপ থাকব অথবা ফেসবুকে নিন্দা জানিয়ে বসে থাকব; তাহলে না, ইসলাম শান্তির ধর্ম নয়। তখন ইসলাম শান্তি প্রতিষ্ঠার ধর্ম এবং ঐ জালিম কাফিরদের চিরতরে ধ্বংস করে উম্মাহর নারী শিশুদের রক্ষা করা তখন মুসলিমদের দায়িত্ব।
ইসলাম আমাদেরকে দয়াশীল হতে শিখায় কিন্তু এর পাশাপাশি প্রয়োজনে কঠিন হবারও আদেশ দেয়। কিছু উদাহরণ দিলে বুঝা যাবে:
১) ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযার সাথে মুসলিমদের চুক্তি ছিল যে, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে তারা মুসলিমদের সহায়তা করবে কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তারা মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলস্বরূপ খন্দকের যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশে বনু কুরাইযার সকল পুরুষ এবং সাবালক বালককে হত্যা করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, এই সংখ্যা ৪০০ থেকে ৯০০। এর ফলে আর কোন ইহুদি গোত্র মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পায়নি।
২) মদিনায় একবার ইহুদিরা এক মুসলিম নারীর আব্রুর উপর হাত দেয়। এর বদলা হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ পুরো গোত্রটিকেই মদিনা থেকে বহিস্কার করে দেন।
৩) কাব বিন আশরাফ এক ইহুদি কবি ছিল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিম নারীদের নিয়ে অশ্লীল কবিতা লিখত যেমনটা বর্তমান জামানার নাস্তিকরা করে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাব বিন আশরাফকে এর জবাব পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার (রা.) মাধ্যমে। মাসলামা (রা.) কাব বিন আশরাফকে জবাব দিয়েছিলেন, তবে তার গর্দানে ধারালো তরবারি দ্বারা।
৪) আবু বকর (রা.) এর খিলাফতকাল। কিছু দুনিয়ালোভী আরব গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানাল। তারা নামায, রোযা, হজ্জ সব পালন করবে কিন্তু যাকাত দিবে না। আবু বকর (রা.) ঐ সব গোত্রকে মুরতাদ ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। পরিণামে সমগ্র আরব ইসলামের পতাকাতলে চলে আসে।
এরকম আরও হাজার হাজার উদাহরণ দেয়া যাবে। তবে মূল কথা হল, আমাদের সময় বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কাফিরদের প্রতি অতি উদারতা এবং মজলুম নারী-শিশুদের পক্ষে লড়াই করা ছেড়ে দেওয়ার কারণেই উম্মাহর আজকের এই অবস্থা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা আই’নাহতে (সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বা লেনদেন) লিপ্ত হয়ে যাবে আর তোমরা গরুর লেজ ধরে থাকবে আর কৃষিকাজে তৃপ্ত হয়ে যাবে এবং যখন তোমরা জিহাদকে ছেড়ে দিবে তখন আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন আর তা তোমাদের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে না যতক্ষণ না তোমরা দ্বীনে ফিরে যাও”। [আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৩৪৬২, হাদিসের মান: সহীহ]
বর্তমান দুনিয়া ফিতনা ফাসাদে ভরে গেছে, মুসলিমরা সব জায়গায় নির্যাতিত হচ্ছে, কাফিরদের হাতে কাশ্মির, মায়ানমার, সিরিয়ার বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হচ্ছে, উম্মাহর শিশুরা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাই সময় এখন নবীর পথ অনুসরণ করার। জেরুজালেমকে মুসলিমদের ফিরিয়ে দেয়ার, কুফরি শাসন ব্যবস্থাসমূহকে সমূলে উৎপাটন করে আবার শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা করার। তাহলেই আবার এই দুনিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের রক্ষার জন্যে? যারা বলে: হে আমাদের প্রতিপালক, জালেমের এই জনপদ থেকে আমাদেরকে উদ্ধার কর। তোমার কাছ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী পাঠাও”। (সূরা নিসা, আয়াত ৭৫)
গত ৪ জুলাই, ২০১৬ইং আন্তর্জাতিক শান্তি সংস্থা ইউনেস্কো এক বিবৃতিতে ইসলামকে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে। বিভিন্ন ধর্মের ওপর গবেষণা করে প্রতি ছয় মাস পরপর ইউনেস্কো এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। ইউনেস্কোর ধর্মতত্ত্ব গবেষণা বিভাগের প্রধান রবার্ট ম্যাগি বলেন, ‘ছয় মাস গবেষণা ও চুলচেরা বিশ্লেষণের পর আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, অন্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ধর্ম।’ সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদের ঘটনা উল্লেখ করে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে ম্যাগি বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। ইসলাম মানে শান্তি। সুতরাং ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ ‘শান্তির ধর্ম ইসলাম’ এই বাণী সংবলিত একটি সার্টিফিকেটও দিয়েছে ইউনেস্কো। তুরস্কের এক তরুণ চিত্রশিল্পী এর ডিজাইন করেন। শান্তির প্রতীক হিসেবে মুসলিম দেহ, মাদ্রাসা, মসজিদ ও হালাল খাবারের দোকানের ছবিও প্রদর্শন করে ইউনেস্কো।
