2:04 AM, 13 November, 2025

অবশ্যই তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না!

IMG_20190824_204022
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ

হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহ্‌র তাক্বওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না।
O you who believe! be careful of (your duty to) Allah with the care which is due to Him, and do not die unless you are Muslims.

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্‌র তাক্বওয়া অর্জনের হক্ক আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাক্বওয়ার ঐ স্তর অর্জন কর, যা তাক্বওয়ার হক। কিন্তু তাক্বওয়ার হক বা যথার্থ তাক্বওয়া কি? আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ, রবী, কাতাদাহ ও হাসান রাহিমাহুমুল্লাহ বলেন, তাকওয়ার হক হল, প্রত্যেক কাজে আল্লাহ্‌র আনুগত্য করা, আনুগত্যের বিপরীতে কোন কাজ না করা, আল্লাহকে সর্বদা স্মরণে রাখা- কখনো বিস্মৃত না হওয়া এবং সর্বদা তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা- অকৃতজ্ঞ না হওয়া। [ইবন কাসীর]

এতে বুঝা যায় যে, পূর্ণ ইসলামই প্রকৃতপক্ষে তাক্বওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ আনুগত্য করা এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকার নামই হচ্ছে তাক্বওয়া অবলম্বন। আয়াতের শেষে মুসলিম না হয়ে যেন কারও মৃত্যু না হয় সেটার উপর জোর দেয়া হয়েছে। দুনিয়াতে ঈমানদারের অবস্থান হবে আশা-নিরাশার মধ্যে। সে একদিকে আল্লাহ্‌র রহমতের কথা স্মরণ করে নাজাতের আশা করবে, অপরদিকে আল্লাহ্‌র শাস্তির কথা স্মরণ করে জাহান্নামে যাওয়ার ভয় করবে। কিন্তু মৃত্যুর সময় তাকে আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা নিয়েই মরতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা না নিয়ে মারা না যায়” [মুসলিম: ২৮৭৭] অর্থাৎ মৃত্যুর সময় তার আশা থাকবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন।

সুরার শুরতেই বলা হয়েছে, সুরা আলে ইমরাণও সুরা বাক্বারার মত দুই অংশে বিভক্ত। তিনটি উপভাগ সহ প্রথমাংশ শেষ হয়েছে, শুরু হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় অংশ। ১০টি রুকুর প্রথম দুইটি রুকুতে ইসলামের প্রথমিক কথা, ইসলাম কায়েম করার পথের দিশা আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম তিনটি আয়াত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুরা ‘আল আসর’ এর মত তাকওয়ার জন্য অতি উৎকৃষ্ট আয়াত। প্রথমটি ব্যাক্তি চরিত্র গঠন সম্পর্কীত, দ্বিতীয়টি উন্নত চরিত্রের সহমত বা সমমনা ব্যাক্তিবর্গের একত্র হবার উপায় ও মাধ্যম ও তৃতীয়টি ইসলাম কায়েমের লক্ষে জমাত বা দলবদ্ধ হওয়া এবং সফলকাম হওয়ার নিশ্চয়তার বর্ণনা নিয়ে।

এ আয়াতে তাক্বওয়া শব্দের অর্থ ভয় বলা হয়েছে। তাক্বওয়ার সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ নাই। ইসলামী পরিভাষায় কয়েকটি আচরণের সমাহারকেই তাক্বওয়া বলে। যেমন:-ধর্মানুরাগ, খোদাভীতি, সংযমশীলতা ও মিথ্যাচার ইত্যাদি।

এ সমস্ত গুণাবলীর শিকড়ে অবস্থানকারীকেই মুত্তাকী বলে। মুমিনগণকে মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, মুমিন অপেক্ষা মুসলিমের গুরুত্ব বেশী। শব্দদ্বয় একটির জায়গায় অন্যটি ব্যবহার হয়ে থাকে। ইমান অন্তরের বস্তু আর ইসলাম আচরণের বস্তু। ইমানকে আচরণে প্রকাশ করাতেই পূর্ণাঙ্গতা। সে কথাই বলা হয়েছে।
কলেমা নামাজ, রোজা প্রভৃতি যথাযত পালন করেই আমরা ভাবি ইসলাম পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেছে, কিন্তু আসলে কি তাই?

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, তিনি জ্বীন ও ইনসানকে শুধুই তার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু সঙ্গে দিয়েছেন পার্থিব চাহিদা। শুধুমাত্র ইবাদত করতে গেলে এগুলোর কি হবে। অতএব আমাদের সেই ইবাদতের তাৎপর্য বুঝতে হবে। ফরজ ইবাদতের বাইরে প্রতিটা কাজই যদি আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তারই উপর ভরসা করে করি তবে তাও হবে ইবাদত। আর এখানেই হল সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, তখনই হব আমরা মুসলিম।

وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللّهِ جَمِيعًا وَلاَ تَفَرَّقْ وَاذْكُرُواْ نِعْمَةَ اللّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاء فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىَ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
অর্থাৎ আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়হস্তে ধারণ কর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না, আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ করো যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। অতএব তারই অনুগ্রহে ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা এক অগ্নিকুণ্ডের কিনারায় অবস্থান করছিলে, অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদের মুক্তি দিয়েছেন। এ ভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শন সমুহ তোমাদের জন্য প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হও।”

মুত্তাকী হওয়ার পরই একতাবদ্ধ হওয়ার পালা। মানুষকে একতাবদ্ধ করতে প্রয়োজন, সহমত, নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও মাধ্যম। এ আয়াতে আল্লাহ সেই মাধ্যমের সন্ধান দিলেন। সুরা বাক্বারায় আমরা দেখেছি কোরআনকে মজবুত হাতল বলা হয়েছে, এখানে মজবুত রশি বলা হচ্ছে। যার এক প্রান্ত আল্লাহর কাছে, অপর প্রান্ত মানুষের কাছে, হাদীসে বলা হয়েছে। এই কোরআনের মাধ্যমেই আল্লাহ মদীনার আওফ ও খাজরাজ গোত্রের দীর্ঘ দিনের শত্রুতাকে সম্প্রীতিতে বদলে দিলেন। তারা আপোষে ভাই ভাই হয়ে গেল। এ যেন তারা ধ্বংসের প্রান্তসীমা থেকে ফিরে এল। শুধু তাই নয় মোহাজীর ও আনসারগণের ভ্রাতৃত্ব নজির বিহীন হয়ে আছে।

وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
অর্থাৎ আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিৎ যারা সৎ কর্মের প্রতি আহবান জানাবে, ভাল কাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখবে। আর তারাই হবে সফলকাম।
মুত্তাকীগণ কোরআনের এর মাধ্যমে জমাত বদ্ধ হওয়ার পর তাদের সামনে তিনটি কাজের দায়িত্ব এসে গেল। প্রথমটি সৎকর্মের প্রতি আহ্বান। দ্বিতীয়টি ভাল কাজের নির্দেশ ও তৃতীয়টি অন্যায় হতে অন্যকে বিরত রাখা বা বাধা দেওয়া। অন্যায় হতে বিরত রাখার তিনটি স্তর আছে। প্রথমটি শক্তি প্রয়োগে বাধা দেওয়া। প্রথমটি সম্ভব নাহলে দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ ভাল কথায় বুঝিয়ে অথবা প্রতিবাদী ভাষায় বাধা দেওয়া। যদি এটিও অসম্ভব হয় তবে, তৃতীয়টি, অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা। সাথে সাথে দ্বিতীয়টির জন্য তৈরী ও পরে প্রথমটির উপযুক্ত হয়ে শক্তি প্রয়োগে বাধা দেওয়া। তৃতীয় অবস্থাটিকে ইমানের দূর্বলতম অবস্থান বলা হয়েছে। আর যারা একাজ যথাযথ পালন করবে তারাই হবে সার্থক বা সফলকাম। আর এভাবেই কোরআনের বাণী বা ইসলামকে বিশ্বের দরবারে বিস্তৃত করতে হবে। ‘মিনকুম’ শব্দ দ্বারা ইসলামের বৃহত গোষ্ঠী হতে ক্ষুদ্র দলে আনা হয়েছে।

وَلاَ تَكُونُواْ كَالَّذِينَ تَفَرَّقُواْ وَاخْتَلَفُواْ مِن بَعْدِ مَا جَاءهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُوْلَـئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
অর্থাৎ আর তাদের মত হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং নিদর্শণ সমূহ আসার পরও বিরোধিতা করতে শুরু করেছে; তাদের জন্য রয়েছে ভয়ঙ্কর আজাব।

يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكْفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُواْ الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ
অর্থাৎ সেদিন  কোন মুখ উজ্জ্বল হবে, আর কোন মুখ হবে কালো। বস্তুত যাদের মুখ কালো হবে, তাদের বলা হবে, তোমরা কি ইমান আনার পর কাফের হয়ে গিয়েছিলে? এবার সে কুফরীর বিনিময়ে আজাবের স্বাদ গ্রহণ কর।

যারা ইমান আনার পর ইসলাম ত্যাগ করবে বা কাফের হয়ে যাবে, কেয়ামতের দিন তাদের চেহারা কালো হয়ে যাবে। এখান থেকেই তাদের আজাব শুরু হবে। অপর পক্ষে ইমানদারদের চেহারা উজ্জ্বল হবে।

وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
অর্থাৎ আর যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা থাকবে রহমতের মাঝে, তাতে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে।

تِلْكَ آيَاتُ اللّهِ نَتْلُوهَا عَلَيْكَ بِالْحَقِّ وَمَا اللّهُ يُرِيدُ ظُلْمًا لِّلْعَالَمِينَ
অর্থাৎ এগুলো হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ, যা আপনাদের যথাযথ পাঠ করে শোনানো হচ্ছে। আর আল্লাহ বিশ্ব জাহানের প্রতি উৎপীড়ন করতে চান না।

وَلِلّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ وَإِلَى اللّهِ تُرْجَعُ الأُمُورُ
অর্থাৎ আর যা কিছু আসমান ও জমিনে রয়েছে, সে সবই আল্লাহর এবং আল্লাহর প্রতিই সব কিছু প্রত্যাবর্তনশীল।

মো. স্বপন হোসেন,  কামিল মাস্টার্স, আল-কোরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ অধ্যয়নরত, মঙ্গলবাড়ীয়া কামিল মাদরাসা, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।