কলাম “মহিমান্বিত মিরাজ”

মুসলিম জীবনের তিনটি পবিত্র রজনীর মধ্যে লাইলাতুল মেরাজ অন্যতম। মেরাজ রাসূল সা:-এর অন্যতম মুজেজা বা অলৌকিক ঘটনা। অন্য দু’টি হলো লাইলাতুল কদর ও লাইলাতুল বরাত। এর মধ্যে লাইলাতুল মেরাজ ও লাইলাতুল কদরের কথা পবিত্র কুরআনেও উল্লেখ আছে। মসজিদে হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা বলা হয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘পবিত্র তিনি, যিনি তাঁর বান্দাহকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন। (সূরা বনি ইসরাইল : ১)। মেরাজ : মেরাজ শব্দের অর্থ সিঁড়ি বা ধাপ যার মাধ্যমে ওপরে ওঠা যায়। মসজিদে আকসা থেকে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ভ্রমণকে মেরাজ বলা হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই তিনি (মুহাম্মদ সা:) তাকে (জিব্রাইল আ:-কে) আরেকবার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে, যার কাছেই রয়েছে বসবাসের জান্নাত”। (সূরা নজম : ১৩-১৫)। *( সিদরাতুল মুনতাহা হল সপ্তম আকাশে আরশের ডান দিকে একটি কুল জাতীয় বৃক্ষ, সকল সৃষ্টির জ্ঞানের সীমার শেষ প্রান্ত, তারপর কি আছে একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন। ইসলামের ইতিহাসে মেরাজ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যখন সব দিক থেকে রাসূল সা: মারাত্মক সঙ্কট ও শোকের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেই দুঃসময়ে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবিবকে তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন। পার্থিব জীবনের অভিভাবক চাচা আবু তালেবের মৃত্যু, প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণী উম্মুল মুমেনিন হজরত খাদিজা রা:-এর ইন্তেকাল, তায়েফের হৃদয়বিদারক ঘটনা, মক্কার কাফেরদের অমানবিক আচরণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মেরাজের মাধ্যমে তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয় রাতের পরই আছে ভোর। ইসলামের বিজয় সমাগত, যার জন্যই তিনি সংগ্রাম করছিলেন। সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে পূর্ণতা লাভের সবকও দান করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে আলমে বারযাখ, জান্নাত, জাহান্নাম, লওহে কলম, আরশ-কুরসি, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সব কিছু দেখান এবং অনন্ত রহস্যের ভাণ্ডার তার সামনে উন্মুক্ত করে দেন। মেরাজের মাধ্যমেই আরববাসীর সামনে ইসলামি রাষ্ট্রের নীলনকশা পেশ করা হয়। মেরাজ থেকে এসে সমগ্র বিশ্বের সামনে রাসূল সা: সেই নীলনকশা তুলে ধরেন। শবে মেরাজের প্রকৃত শিক্ষা।
রাসূল সা: মেরাজ থেকে ফিরে আসার পর সূরা বনি ইসরাইলের ২২ থেকে ৩৭ নং আয়াতের মাধ্যমে ১৪ দফা জনগণের সামনে পেশ করেনঃ
১. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক কোরো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে। আর তোমরা কেবল আল্লাহরই বন্দেগি করো (সূরা বনি ইসরাইল-২২)।
২. বাবা-মার সাথে ভালো ব্যবহার করো। তাদের একজন বা উভয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় যদি তোমাদের সামনে উপনীত হয় তাহলে তাদের সাথে উহ্ শব্দটি পর্যন্ত কোরো না। তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না; বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর তাদের সামনে বিনয়ী থেকো আর দোয়া করতে থাকো- ‘হে আমার প্রতিপালক, তাদেরকে তেমনিভাবে লালন-পালন করো, যেমনি তারা শৈশবে আমাদের লালন-পালন করেছেন’ (সূরা বনি ইসরাইল ২৩-২৪)।
৩. তোমাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের মনের খবর জানেন (সূরা বনি ইসরাইল-২৫)।
৪. আত্মীয়স্বজনকে তাদের অধিকার দাও আর মিসকীন ও মুসাফিরদের হক আদায় কর (সূরা বনি ইসরাইল-২৬)।
৫. অপব্যয় কোরো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই, আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ (সূরা বনি ইসরাইল-২৭)।
৬. হকদারদের হক আদায়ে তুমি যদি অপারগ (অসমর্থ) হও তাহলে তাদের সাথে অত্যন্ত নম্রভাবে কথা বলো (সূরা বনি ইসরাইল-২৮)।
৭. ব্যয়ের ক্ষেত্রে বেহিসাবি হয়ো না, আবার কৃপণতাও প্রদর্শন কর না। আল্লাহ যাকে চান রিজিক বাড়িয়ে দেন, যাকে চান কমিয়ে দেন (সূরা বনি ইসরাইল : ২৯-৩০)।
৮. দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই এটি মহাপাপ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩১)।
৯. জিনা-ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চই এটি নিকৃষ্ট ও গর্হিত কাজ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩২)।
১০. কোনো জীবনকে অন্যায়ভাবে হত্যা কোরো না। কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে তার উত্তরাধিকারীকে আমি এই অধিকার দিয়েছি (চাইলে রক্তের বিনিময় চাইতে পারে), তবে প্রতিশোধের ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৩)।
১১. এতিমের সম্পদের ধারেকাছেও যেও না। সম্পদের ব্যাপারে তার বয়োপ্রাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করো আর প্রতিশ্রতি সম্পর্কে সচেতন থাক। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৪)।
১২. মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মাপে দিবে এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়ি পাল্লায়। এটিই উত্তম পন্থা এবং এর পরিণাম শুভ। (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৫)।
১৩. যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সেগুলোর পেছনে লেগো না। নিশ্চয়ই চোখ, কান, অন্তর সব কিছুই জিজ্ঞাসিত হবে (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৬)।
১৪. জমিনে দম্ভসহকারে চলো না। তুমিতো কখনও জমীনে ফাটল ধরাতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনও পাহাড় সমান হতে পারবে না। (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৭) এই ১৪ দফাই শবেমেরাজের প্রকৃত শিক্ষা।
- সংকলনে: মুহাম্মাদ আল-আমিন খাঁন, বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং কলামিস্ট
