লাখো লাখো মুসল্লিদের মোনাজাতে শেষ হল পীরে কামেল আলহাজ্ব হযরত মাওঃ আঃ হালীম হুছাইনী (র.) এর প্রতিষ্ঠিত তারাকান্দি জামিয়া হুছাইনীয়া আছ আদুল উলুম কওমী ইউনিভার্সিটি ময়দানে খতমে বুখারী শরীফ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ৫৩ তম বার্ষিক ইছলাহী ও তালিমী জলছা ২০২১।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও লাখো লাখো মুসল্লিদের আগমনে মুখরিত ছিল তারাকান্দি অঞ্চল। জলছাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি রাস্থায় রাস্থায় এলাকাবাসীর ব্যবস্থপনায় ছিল চলাচলের দারুন সুবিধাদী।
১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ইং রোজ রবি ও সোমবার খতমে বুখারী শরীফ উপলক্ষে দু’দিন ব্যাপী এ জলসায় আন্তর্জাতিক ও দেশ বরেণ্য ওলামায়কেরামগন ইসলামী বয়ান পেশ করেছেন। চলা দুই দিন ব্যাপী তালিমী জলছা শেষে মঙ্গলবার সকাল সারে নয়টায় হাটাজারি মাদ্রাসার সিনিয়র মুফতি জসিম উদ্দিন দাঃবাঃ সাহেবের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় আখেরী মোনাজাত। মোনাজাতে অংশ নেয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রায় ৬-৭ লাখ মুসল্লি।
জলছায় উপস্থিত সকল আশেকান, জাকেরান, মুরিদান ও আগত মুসল্লিদের বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মুহতামিম ও হুজুরের সুযোগ্য নাতি আলহাজ্ব রশিদ আহমেদ জাহাঙ্গীর হুছাইনী।
বার্ষিক ইছলাহী ও তালিমী জলছার আয়োজনসহ ধারণা করা প্রায় ৬-৭ লাখ মুসল্লিদের সকল প্রকার খেদমতে কাজ করেছেন হুজুরের প্রতিষ্ঠিত তানজিমুল মুসলিমিন এর আদলে “হুসাইনীয়া স্বেচ্ছাসেবী তওহীদি যুব সংঘ” এর প্রায় ৫ হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবক। কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক এনামুল হক দেশেররার্তাকে জানান, প্রতি বছরের ন্যায় মাহফিল কে সফল করতে প্রায় ১৬০০ এর বেশি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক টিম করে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ পরিচালনা করেন। জলছা বাস্তবায়ন ও পরিচালনায় অংশ নিয়েছিল হুসাইনীয়া স্বেচ্ছাসেবী তওহীদি যুব সংঘের ৩৫ টির বেশি আঞ্চলিক শাখা ও পাঁচ হাজারের অধীক স্বেচ্ছাসেবক। সকলকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন হুজুরের শিষ্য আলহাজ্ব আব্দুল হেকিম কবিরাজ, সংগঠনটির সভাপতি মাসুদুর রহমান মাসুদ ও সাধারন সম্পাদক এনামুল হক। সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল ইসলাম হিমেল জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি তিন ধরনের স্তরের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক এবার মাঠে ও সমগ্র এলাকায় নিরাপত্তা ও আগত মুসল্লিদের সার্বিক সহযোগিতায় কাজ করেছে।
এছাড়াও অসুস্থ্য ব্যক্তিদের জরুরী চিকিৎসা সেবায় কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যবস্থাপনায় ‘ফ্রেন্ডস ব্লাড ডোনার ক্লাব’ জরুরী স্বাস্থ্যসেবা, ঔষধ বিতরণ সহ বিভিন্ন সেবা পরিচালনা করেছে বলে জানান যুগ্ন সাধারন সম্পাদক জুনায়েদুল হক শাহীন, এস.এম. মিজানুর রহমান, হুমায়ুন কবীর সহ অন্যরা।
হুজুরের বিভিন্ন কারামতি ও ইসলামী কর্মকান্ড নতুন প্রজন্মকে জানার আহবান ও বিভিন্ন কর্মকান্ড সবসময় প্রচারনার জন্য বিশেষ অনুরোধ ও মিডিয়া কর্মীদের ধন্যবাদ জানান আইটি ও মিডিয়া সম্পাদক রাজন আকন্দ।
আব্দুল হালিম হোসাইনী (রহঃ) এঁর জীবনী থেকে জানা যায়:-
তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন প্রাইমারী মক্তবে। কোরআন শিখেন তাঁর মায়ের কাছে। ১৯১৯ সালে তারাকান্দি সিনিয়র মাদ্রাসা স্থাপিত হওয়ার পর ১৯২৬ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন এবং কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে শেষ পরীক্ষায় ৩য় স্থান অর্জন করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে এফ.এম পাশ করেন।
১৯৩০ সালে তিনি দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসায় দাওরা হাদিসে ভর্তি হন। সেখানে দাওরায়ে হাদিস ও তাফসীরে ১ম স্থান অর্জন করেন এবং দারুল উলুম দেওবন্দ টাইটেলের বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৩১ সালে তিনি লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে শিক্ষা অর্জন করার পর পাঞ্জাব (লাহোর) ইউনিভার্সিটি থেকে ফাজেল উপাধি লাভ করেন। যতই দিন যায় ততই হযরত হুসাইনীর জ্ঞান লাভের তীর্ব আশা আকাঙ্ক্ষা বাড়তেই থাকে।
তিনি তার জ্ঞান পিপাসা পূর্ণ করার মানসে তৎকালীন ভারতের ওলীকূল শিরোমণি আরব আজমের উস্তাদ শায়খুল ইসলাম,সাইয়্যেদ হুছাইন আহমদ মাদানী (রহঃ)এর দরবার শরীফে নিজেকে সোপর্দ করেন। মাদানী (রহঃ) এর দরবার শরীফে অবস্থান কালে লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজ ও মাতৃভূমি তারাকান্দি থেকে হুসাইনীর কাছে শিক্ষকতার প্রস্তাব আসে। কিন্তু মাদানী (রহ.) শিষদের মধ্যে বয়: কনিষ্ঠ সুদর্শন তরুণ হালিমকে কিছুতেই তাঁর সংশ্রব যেতে অনুমতি দেননি।
জবাব এল এখনও সময় হয়নি। সময়ের কালচক্রের ঘূর্ণয়ে একদিন এর পরিসমাপ্তি ঘটে। লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজের সম্মানিত অধ্যাপকের পদ মর্যাদাকে উপেক্ষা করে মাতৃভূমির ডাকে সাড়া দিয়ে তারাকান্দি মাদরাসার উন্নতির জন্য সব মায়া ত্যাগ করে চলে আসেন নিজ বাড়িতে। ১৯৩৭ সালে তিনি বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হন।
আব্দুল হালিম হুসাইনী (রহঃ) তারাকান্দি সিনিয়র মাদরাসায় ৩-৪ বছর শিক্ষকতা করার পর অনিবার্য কারন বশত এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ইশ^রগঞ্জ থানার ধনিয়াকান্দি হামিদিয়া মাদরাসায় ৪ বছর, কিশোরগঞ্জের আউলিয়াপাড়া মাদরাসায় ৬ বছর, নান্দাইল থানার জাহাঙ্গীর-পুর সিনিয়র মাদরাসায় ৪ বছর কাল অধ্যাপনার কাজ করেন। এছাড়াও তিনি অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা,স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট,পুল নির্মাণ করে নজিরবিহীন কর্মপ্রেরণা হিসেবে দেশবাসীর কাছে চির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিঁনি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। যদিও ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে তিঁনি দলগত রাজনীতি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সমর্থন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। পাক-বাহিনী বা মুক্তিবাহিনী কোন দলকেই তিনি সক্রিয় সমর্থন করেননি। মাওলানা আতাউর রহমান খান (সাবেক এমপি) ২০০৯ সালে জলসায় তিনি তার বক্তব্যে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের এত্তেহাদুল উলামার ডাকা ১৯৭০ সালের কনফারেন্সে আব্দুল হালিম হোসাইনী (রহঃ) উপস্থিত আলেমগনকে লক্ষ করে বলেছিলেন-আপনারা জেনে রাখুন,বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে , এর বিরোধীটা করে কোন লাভ নেই। তখন আলেমগন তাঁকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে ছিল।
জনাব হুছাইনী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও পাকবাহিনী কর্মকর্তাদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন-তোমরা যদি নির্মম অত্যাচার বন্ধ না কর নিশ্চয়ই জেনে রাখ তোমাদের হুকুমাত ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমাদের বিজয় অসম্ভব। এ দেশের মাটি থেকে লাজ্ঞিত হয়ে তোমাদের বিদায় নিতে হবে। ঠিক তাই হল। প্রতিনিয়ত মুক্তি ফৌজেরা দলে দলে এসে হুজুরের কাছে দোয়া চাইতো। বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধারা একত্র হয়ে কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে হুছাইনীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। তাছাড়া স্বাধীনতার ১৭ দিন বয়সের সময় পাকুরিয়া মাদরাসায় অনুষ্ঠিত সভায় সৈয়দ আঃ সুলতানসহ বহু আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে তাদের বক্তব্য -ধর্ম ও রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা এর বিরুদ্ধে জনাব হুছাইনী তার ভাষনে জোর প্রতিবাদ করেন।
তিনি বলেন “আদ্দীনু ওয়াল মুলকু তাওআমান ”অর্থাৎ ধর্ম ও রাজনীতি জমজ সন্তানের ন্যায়। রাজনীতিতে তিঁনি কখনও পিছপা ছিলেন না। তিনি পাকুন্দিয়া মাদরাসা ময়দানে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমিন ও ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস ময়দানে পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধান জনাব আইয়ূব খানের অনুরূপ উক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন। জনাব হুছাইনী খুবই ন্যয় পরায়ণ সৎ ও প্রতিবাদী ছিলেন।
তার অনেক মোজেজা এখনো লোক মুখে প্রচলিত ও প্রতিফলিত। কয়েক যুগ আগের কথা – বরিল্যা গ্রামের উপর দিয়ে রাজাবাড়িয়া যাচ্ছিলেন হুছাইনী হুজুর, সাথে অনেক লোক। হঠাৎ একটি জলাধারের নিকট থেমে গেলেন। বললেন- বেকুবের দল,মসজিদে বীজ তলা করে রেখেছে। সাথী শিষ্য তাঁর এক প্রিয় ছাত্র ইয়াকুব আলী বললেন-এখানে মসজিদ কোথায় দেখলেন হুজুর ? হুছাইনী সেখানে দু-রাকাত নামাজ পড়ে চলে গেলেন। ২ বছর পর সেখানে ঠিকই একটি মসজিদ ও ফুরকানিয়া মাদরাসা স্থাপিত হয়।
আউলিয়াপাড়া যাওয়ার পথে একটি শিমুল গাছ। গাছের কান্তা (বড় শিঁকড়) রাস্তা বরাবর বাড়তেছে । হুছাইনী হজুর সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় তার চোখে পড়লো এইগাছের কান্তা। তিনি গাছের কান্তায় হাত বুলিয়ে বললেন-যেন রাস্তার দিকে আর না আসে। তাহলে রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচলে অসুবিধা হবে। কিছুদিন পর কান্তাটি আবার ইউ আকৃতির মত ঘুরে গেল। এখনো গাছটি সেখানে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।
এলাকার প্রবীণ মুরুব্বীদের কাছ থেকে জানা যায় বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ এরশাদ তার জীবদ্দশায় কোন এক সময় এসেছিলেন হুজুরের দোয়া নিতে, রাষ্ট্রপতি এরশাদকে তার নামের আগে হোসাইন শব্দটি সংযুক্ত করে দেন এই বুজুর্গ। এর পর থেকে তার নামের আগে হোসাইন যুক্ত করে লিখা হয় হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ।
আল্লামা আব্দুল হালিম হুছাইনী (রহঃ) পৃথীবির মায়া ত্যাগ করে মহান এই সাধক, বুজুর্গ নিজ বাড়িতে ১৯৮৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, ২৭ ভাদ্র, ৭ মহরম শুক্রবার দিবাগত রাত্রে ইন্তেকাল করেন। পরদিন পাকুন্দিয়া পাইলট হাই স্কুল মাঠে লাখো মুসল্লির অংশগ্রহনে মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মরহুমের জানাজায় ইমামতি করেন-আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আলেম আল্লামা সৈয়দ মোসলেহ উদ্দিন (রহঃ)। জানাজা শেষে তাঁর নিজের হাতে গড়া তারাকান্দি জামিয়া হুসাইনিয়া আছ-আদুল উলুম কওমি ইউনিভার্সিটি ময়দানে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।
সম্পাদক: শামীম আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক: এস এম মিজানুর রহমান মামুন, প্রকাশক: রাজন আকন্দ
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দেশেরবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম