মারুনা রাহী রিমিঃ
একটি গল্প শুনেছিলাম, এক ব্যক্তি তার বাবাকে কল করে তার স্ত্রী কে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে বলছিল,
"বাবা ! আমি আর আমার স্ত্রীর সাথে থাকতে পারবো না। সে আমাকে আগের মত আর ভালবাসে না। সে এখন আর আগের মত নেই। সে আমাকে আগের মত কেয়ার করে না। আমাকে দেখেও আগের মত হাসে না। আমার পছন্দ মত সাজগোজ করে থাকে না। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। তার কাছে শুধু সন্তান ও সংসার ই বেশি গুরুত্ব পায়। সে আর আগের মত সকল দায়-দায়িত্ব পালন করে না। আমার জন্য আগের মত পছন্দের খাবার রান্না করে না। আমি তার সাথে আর থাকবো না। তাকে আমি তালাক দিয়ে দিব।"
বাবা ছেলের সকল কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর তিনি তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ তবে আরও একবার ভেবে দেখতে পার। একটিবার ভেবে দেখো এবং মনে করে দেখো, বিয়ের সময় তুমি তোমার স্ত্রীকে যে সকল ওয়াদা গুলো করেছিল, যে সকল দায়-দায়িত্ব পালন করবে বলে কথা দিয়েছিলে সেগুলো কি তুমি আসলেই মেনে চল?
ছেলে বিয়ের সময় স্ত্রীর কাছে দেয়া সকল ওয়াদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে একবার ভাবতে শুরু করল। সে ভেবে দেখল যে, সে নিজেও তার কোন দায়-দায়িত্ব পালন করে না। স্ত্রীকে আগের মত ভালবাসার কথা বলে না, আগের মত তার সাথে গল্প করে না, আগের মত তাকে সময় দেয় না, আগের মত তাকে সারপ্রাইজ দেয় না, আগের মত তার জন্য বিশেষ কিছু করে না, তাকে সংসারের কাজ কর্মে সাহায্য করে না, আগের মত কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায় না, আগের মত একসাথে সুন্দর সময় কাটায় না।
বাবাকে এসব কথা বলার পর তার বাবা তাকে ১ মাস সময় নিয়ে নিজের দায়-দায়িত্ব গুলো সুষ্ঠু ভাবে পালনের নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ১ মাস পরেও যদি তোমার মনে হয় যে, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে আর থাকতে পারবে না তখন তুমি তাকে তালাক দিয়ে দিও এবং আমি তোমাকে পূর্ণ সাপোর্ট করবো।
ছেলে বাবার কথামত নিজের স্ত্রীর সাথে ভাল ব্যবহার শুরু করল, স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করা বন্ধ করে দিলো, স্ত্রী রেগে গেলেও স্ত্রীর মান ভাঙ্গাতে নানা ভাবে চেষ্টা শুরু করল। স্ত্রীকে সংসারের কাজে সাহায্য করতে শুরু করল, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার নানা প্ল্যান করল, স্ত্রী কে বিশেষ ফিল করাতে প্রতিদিন নানা ধরনের উপহার, ফুল ইত্যাদি এনে সারপ্রাইজ দেয়া শুরু করল, স্ত্রী কে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে ভালবাসার নানা গল্প করতে শুরু করল।
এমন চলতে চলতে ১ সপ্তাহের মধ্যেই সে স্ত্রীর মাঝে একটা চেঞ্জ লক্ষ্য করল। স্ত্রী স্বামীর পছন্দের কাপড় পড়তে শুরু করল, আগের মত সাজগোজ করতে শুরু করল, স্বামীর পছন্দের খাবার রোজ বানাতে শুরু করল, স্বামীকে দেখেই সুন্দর হাসি দেয়া শুরু করল, একসাথে খাবারের টেবিলে বসে গল্প করতে শুরু করল, স্বামীর ভাল লাগার সব কাজ করতে সে শুরু করল।
সবশেষে ছেলেটি বুঝতে পারলো যে, ভালবাসা ও সুখের দায়-দায়িত্ব শুধু একা তার স্ত্রীর ছিল না। স্ত্রী তাকে ভালবাসার সকল দায়িত্ব পালন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে একদম বদলে গিয়েছিলো। যেই তার স্বামী নিজের দায়-দায়িত্ব পালন করতে শুরু করল, স্ত্রীও যেন পুনরায় জীবন খুঁজে পেল। "
মানুষ হিসেবে রয়েছে আমাদের সবার নানা ধরনের দায়িত্ব, কিন্তু আমরা সব সময় নিজেদের দায়িত্বগুলোও অন্যদের উপরে চাপিয়ে দিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কখনও ভেবে দেখি না যে, অন্যের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি আমাদের নিজেদেরও দায়িত্ব রয়েছে। আমরা সব সময় অন্যের কাছে আশা করি। একবারও ভেবে দেখি না অন্যের জন্য আমাদের দায়িত্ব কি আসলেই আমরা পালন করি?
যেকোনো সমস্যা হলেই আমরা অন্যদের উপরে চাপিয়ে দেই। এক্সিডেন্ট হলে ভাবি "পুলিশ এর দায়িত্ব। অথচ এটা ভাবি না যে পুলিশের সাথে সাথে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। হাসপাতালে মনে করি সব ডাক্তারের দায়িত্ব, এটা ভেবে দেখি না যে আমাদেরও প্রাথমিক কিছু দায়-দায়িত্ব আছে ডাক্তারের আগে। জামজটের জন্য ট্রাফিক পুলিশকে দায়ী করি, একবারও ভেবে দেখি না যে, জ্যামজটের জন্য আমরা সাধারনই বেশি দায়ী।
সন্তানেরাও সবসময় ভাবে, সব দায়-দায়িত্ব শুধু বাবা-মায়ের, তাদের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। আবার বাবা-মায়েরা সন্তান বড় হবার পর মনে করেন, সব দায়িত্ব শুধু সন্তানের(কন্যার), বাবা-মায়ের কোন দায়-দায়িত্ব নাই। শ্বশুর-শাশুড়িদের সমস্যাও একই ধরনের। তারা সব সময় মনে করেন সব দায়-দায়িত্ব ছেলের বউ এর, তাদের কোন দায়-দায়িত্ব থাকে না।
মাঝে মাঝে আমিও হাঁপিয়ে উঠি দায়-দায়িত্ব পালন করতে করতে। কখনও কন্যা হিসেবে, কখনও মেয়ে হিসেবে, কখনও বোন হিসেবে, কখনও স্ত্রী হিসেবে, কখনও ছেলের বউ হিসেবে। আমার যেন কোন জান নাই, সম্মান নাই, ইজ্জত নাই, মান-অভিমান নাই, কষ্ট নাই। আমি যেন নিতান্তই একটা রোবট। যখন বদলানো ছাড়া আর উপায় থাকে না, রোবটের মত হয়ে যাই, তখন মনে হয় সব কিছু ফেলে দিয়ে কোথাও পালিয়ে যাই, হারিয়ে যাই বা ফ্যানের মধ্যে ঝুলে পড়ি বা গাড়ির নিচে পড়ি।
এমনই হয়তো লাগে আমার মত লাখো, কোটি কোটি নারীর। আমরা কেন বুঝতে পারি না যে, সকল দায়-দায়িত্ব শুধু আমাদের একার নয়। আপনাদেরও দায়-দায়িত্ব আছে যা পালন করলে আপনারা হয়তো শুধু মেয়ে নামের রোবট পাবেন না, আর কোন তালাক হবে না, আর কাউকে সুইসাইড করতে হবে না, আর কেও স্বামী সন্তান নিয়ে আলাদা সংসার গড়তে চাইবে না, আর কেউ শ্বশুর বাড়ি থেকে দূরে ও বাবার বাড়িতে বা বাবার বাড়ির সামনে নিজের বাসা নিবে না,আর কোন বউ কোন বাবা-মায়ের বুক থেকে তাদের সন্তানকে দূর করে ফেলবে না, আর কোন বউ তাদের নাতি-নাতনী কে দূর করে ফেলবে না, আর কোন বউ শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে খারাপ ব্যবহার করতো না, বরং মা বাবা মনে করতো।
আমাদেরকে একবার রোবট না ভেবে আপন ভাবুন। আমরা দেখবেন আপনাদের আপন হয়েই গড়ে উঠবো।
সম্পাদক: শামীম আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক: এস এম মিজানুর রহমান মামুন, প্রকাশক: রাজন আকন্দ
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দেশেরবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম