
কলেজ সরকারি কিন্তু ছাত্র ছাত্রীদের পুরোনো নিয়মে বেসরকারি আমলের বেতন ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিষয়টি শিক্ষক ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বিগত শাসনামলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারি স্কুল ও কলেজ বিহীন প্রতি উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণের ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় এপর্যন্ত ৩০২ টি কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে। জিও জারির পর থেকে কলেজের দৈনন্দিন আর্থিক কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে সেই বিষয়ে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা জারি করা হয়। এতে বলা হয় সদ্য সরকারিকৃত কলেজগুলোর দৈনন্দিন আর্থিক কার্যক্রম অধ্যক্ষ ও ইউএনও/ ডিসি এর যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হবে। যতদিন না উক্ত কলেজগুলোর শিক্ষক কর্মচারীদের আত্তীকরণ সম্পন্ন হবে ততদিন ঐ সকল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পুরোনো নিয়মে অর্থাৎ বেসরকারি আমলের টিউশন ফি পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো গত বছরের অগাস্ট মাসে কলেজগুলো সরকারি হলেও আজ-অব্দি নয় মাস পেরিয়ে গেলেও শিক্ষক কর্মচারীদের আত্তীকরণ সম্পন্ন হয়নি। আগামী দুই বছরের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। কারণ এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষক কর্মচারীদের আত্তীকরণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। সবে মাত্র পদ সৃজনের জন্য ৩০২ টি কলেজে প্রথম দিকে থাকা ২০ কলেজের তথ্য ছক পূরনের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। বাকী ২৮২ কলেজের পদ সৃজনের তথ্য ছক পূরনের নির্দেশনা কতদিনের মধ্যে জারি হবে তা নিশ্চিত নয়। এই ক্ষেত্রে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রায়শই বলা হয় পর্যাপ্ত জনবল নেই। পুরো প্রকল্পটি যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় হয়েছে সেহেতু এটির দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিতে সমস্যা কোথায়? বরং দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষক সমাজের কাছে প্রশংসিত হবেন তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
এদিকে শিক্ষক কর্মচারীদের আত্তীকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন না হওয়ায় চারদিকে এর নেতিবাচক প্রভাব পরতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক মহল বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। তারই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া রাজধানীর শ্যামপুরের স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিক্ষোভ। সরকারীকরণের পর পুরোনো নিয়মে টিউশন ফি আদায়ের প্রতিবাদে অত্র কলেজের শিক্ষক ও অভিভাবকরা গত ২৫ মার্চ ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ মহাসড়কে বিক্ষোভ শুরু করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তাদের অভিযোগ দেড় বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে আগের নিয়মে টিউশন ফি আদায় করছে। তারই প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন।
সদ্য সরকারিকৃত প্রায় সকল কলেজেই একই পরিস্থিতি বিরাজমান। আমি আমার কলেজের ( শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজ) কথা বলতে পারি, কিছুদিন আগে ১ম বর্ষ ইনকোর্স পরীক্ষার সময় টিউশন ফি পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের কথা হলো আমি এই কলেজে ভর্তি হয়েছি সরকারি সুযোগ সুবিধা পাবো বলে কিন্তু কৈ? কেন আমি বেসরকারি আমলের টিউশন ফি দিয়ে পড়াশোনা করবো? তাদের এই প্রশ্ন কি অযৌক্তিক? মূলত শংকার জায়গা হলো এখানে যদি ৩০২ টি সদ্য সরকারি কলেজের আনুমানিক প্রায় ১০ লক্ষাধিক ছাত্র ছাত্রী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তাহলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা দূরুহ হয়ে
পরবে।আর এর সাথে যদি যুক্তি হয় অভিভাবকরা তাহলে পরিস্থিতি আরো প্রকট হতে পারে। যে সকল শিক্ষক কর্মচারীরা এই কলেজগুলোর সাথে সরাসরি জড়িত তাদের দূঃখ কষ্টের যেন শেষ নেই। বিশেষ করে যারা নন এমপিও তাদের জীবন চলে অতি কষ্টে। অনেকে ইতিমধ্যে অবসরে গিয়েছেন রিক্ত হস্তে। শিক্ষক সংকট প্রকট হচ্ছে নিয়োগ নিষেধাজ্ঞার কারনে। পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। সর্বপরি শিক্ষকরা সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে, কারন কলেজ সরকারি কিন্তু শিক্ষক বেসরকারি বলে পরিচয় দিতে হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে একজন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে গেল।তিনি সদ্য সরকারিকৃত কলেজের একজন অবিবাহিত প্রভাষক। অনেক রঙ্গিন স্বপ্নের জাল বুনেছেন সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসাবে বিয়ে করবেন। বাড়ি থেকে পাত্রী দেখা শুরু হয়ে গেল। বাবা মনে করলেন ছেলে আমার সরকারি কলেজের প্রভাষক নিশ্চয়ই ভালো ফেমিলিতে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করাতে পারবেন।কনের বাড়িতে হাজির। খানাপিনা শেষ। এক পর্যায়ে মেয়ের বাবা ছেলের বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলের চাকরি কি আত্তীকৃত হয়েছে? ছেলের বাবা আমতা আমতা করে বললেন না, হবে, হয়ে যাবে। মেয়ের বাবা বললেন এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি আমার মেয়েকে ঠেলে দিতে পারিনা। তিনি আরো বললেন অনার্স শিক্ষকরা নাকি ৪/৫ হাজার টাকা বেতন পান? ছেলের বাবা লজ্জায় মাথা নিচু করে ঐ বাড়ি থেকে প্রস্থান করলেন। বাবা ছেলেকে বললেন যেদিন চাকরি সরকারি হবে সেদিন তোকে বিয়ে করাবো বাবা। এই কষ্টের শেষ কবে হবে? আমি স্পষ্ট দেখতি পারছি এসব কলেজের ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে যে চাপা ক্ষোভ, কষ্ট পুঞ্জিভূত হচ্ছে তা যেকোনো মূহুর্তে শিক্ষাক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য শিক্ষক ও কর্মচারীদের আত্তীকরণের জন্য শিক্ষা প্রশাসনের দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। ইতিমধ্যে নন- এমপিও শিক্ষকরা এমপিও এর জন্য আন্দোলন করছেন। এর সাথে যদি যুক্ত হয় সদ্য সরকারিকৃত কলেজের ১০ লাখ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ তাহলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা দূরুহ হয়ে পরবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান, সদ্য সরকারিকৃত কলেজের ছাত্র ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে যে ক্ষোভ, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তার একমাত্র সমাধান এ সকল কলেজের শিক্ষক কর্মচারীদের দ্রুত আত্তীকরণ। আশা করি এজন্য দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে শিক্ষার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সক্রিয় হবেন।
সিরাজুল ইসলাম
প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ,
শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজ, গাজীপুর।
সম্পাদক: শামীম আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক: এস এম মিজানুর রহমান মামুন, প্রকাশক: রাজন আকন্দ
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দেশেরবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম