সঞ্চিতা আলী :
(ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা এক্টিভিস্ট সঞ্চিতা আলী সম্প্রতি কাশ্মীর ঘুরে এসে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন।)
৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের পর দু'মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত। কাশ্মীরে স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত ফিরে আসছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ক্রমাগত যে প্রচার চালাচ্ছে, তা যে কতটা বিভ্রান্তিকর এবং মিথ্যা তা স্পষ্ট হয় উপত্যকায় গিয়ে, সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে। কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি কার্যত ঠিক তার উল্টো এবং তা কেমন সেই নিয়েই এই লেখা।
২৬ সেপ্টেম্বর শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে যাওয়ার পথে লক্ষ্য করি গোটা শহরজুড়ে একটা থমথমে ভাব। রাস্তাঘাট জনমানবহীন। বিক্ষিপ্তভাবে এখানে ওখানে দু' চার জন থাকলেও গোটা শহর কার্যত জনশূন্য। রাস্তাজুড়ে কেবল ভারতীয় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর ভিড়, ফাঁকা রাস্তায় মুহুর্মুহু টহল দিচ্ছে মিলিটারি ভ্যান। কিছু এটিএম আর ওষুধের দোকান ছাড়া সমস্ত দোকানপাট-স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি সবকিছু বন্ধ। অনেকটা পথ পেরোনোর পরও ছবিটা একইরকম।
দু'মাসের বেশি হতে চলল। মোবাইল ইন্টারনেট সব বন্ধ। যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম বিকল হয়ে পড়েছে। এতগুলো দিন কেটে গেছে অথচ আত্মীয়-পরিজন কেমন আছে সেই খবরটুকু পর্যন্ত নেই কারোর কাছে। শ্রীনগরের স্থানীয় এক মহিলা জানান, এসময় কেউ যদি মারা যায়, সেই খবরটুকুও তারা সঙ্গে সঙ্গে পাবেন না। হয়তো চারদিন পর কেউ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আসবে সেই খবর দিতে। তিনি আরো বলেন, ৫ই আগস্টের আগে থেকেই গোটা উপত্যকায় কারফিউ জারি। মানুষ তখন থেকেই নিজের বাড়িতে বন্দী। প্রয়োজন পড়লেও বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছেন। আর একান্তই যদি বেরোতে হয়, তবে তিনি সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা তা একেবারেই অনিশ্চিত। বহু মানুষ রাস্তায় মিলিটারির ছোঁড়া ছররাবন্দুকের গুলিতে আহত হয়েছেন, টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সমস্ত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ থাকার দরুণ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে দূরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ইমারজেন্সি কেসে যদিওবা রোগীকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেরোনো হয়, রাস্তায় সিআরপিএফের বাধার মুখে পড়তে হয়, মাঝরাস্তা থেকে ফিরে আসতে হয়। পেলেট আক্রান্তদের কথা তো আরোই দুঃসহ। তারা তো হাসপাতালে যাওয়ার কথাটুকুও ভাবতে পারেন না। সেখানে আগে থেকেই সেনা মোতায়েন থাকে। পেলেট আক্রান্ত কেউ চিকিৎসার জন্য গেলে, চিকিৎসার পর তারা তাকে জোর করে বেআইনিভাবে তুলে নিয়ে যায়। তারপর তার খবরটুকুও আর তার পরিবারের কাছে পৌঁছায় না। শহরের পাশাপাশি গ্রামের পরিস্থিতি আরোই ভয়ংকর। অল্পবয়সী ছেলেদের মিলিটারি ইচ্ছেমতো তুলে নিয়ে যায় দিনের আলোয়, অবৈধভাবে আটকে রাখে। সম্প্রতি একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৩০০০ কম বয়সী ছেলেকে বেআইনিভাবে উঠিয়ে নিয়ে যায় মিলিটারি। গ্রামের দিকে সার্চের নামে শ্লীলতাহানি এমনকি রেপ করা হলেও তাঁরা মুখ বুঁজে থাকেন। মুখ খুললেই জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে এই ভয়ে কেউ প্রতিবাদটুকু করতে পারছেন না। মানবাধিকার সংগঠন এমএসএফ এর সমীক্ষা থেকে জানা যায়, মিলিটারির অত্যাচার, অবৈধভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয়-আতঙ্ক সাধারণ মানুষকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে উপত্যকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫% জনই আজ মানসিক অবসাদের শিকার।
মোবাইল-ইন্টারনেটের পাশাপাশি সমস্ত স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিও বন্ধ। ইসলামিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক পড়ুয়া ক্ষোভের সাথে জানান, সামনের অক্টোবরে তার সেমিস্টার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো কলেজ খুলল না। ইন্টারনেট ও বন্ধ। পড়াশোনা করতে পারছেন না, কবে কলেজ খুলবে সে বিষয়ে পুরো অন্ধকারে। তাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া এই এতগুলো সময়ের দাম কে দেবে? একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী যিনি মেডিকেলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, জানান, স্কুলের পাশাপাশি যে প্রতিষ্ঠানে মেডিকেলের জন্য টিউশন পড়তে যান তিনি, সেটিও এই দু'মাস বন্ধ। কেউ ভয়ে বাইরে বেরোচ্ছেন না। সবাই আতঙ্কে আছেন। বলেন, "হাম হামারি ঘর মে ক্যায়েদ হো গ্যয়ি হ্যায়।" আর এক কলেজ পড়ুয়া বলেন, কাশ্মীরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ টুকু করতে দেওয়া হয়না। প্রতিবাদ জানালেই তাদের উপর টিয়ার গ্যাস, পেলেট ছোঁড়া হয়।
দশদিন ছিলাম উপত্যকায়। বহু মানুষের সাথে কথা হয়। প্রত্যেকেরই ভারতীয় মিডিয়ার উপর ভয়ানক ক্ষোভ। তাদের কন্ঠরোধ করে, মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়ে 'কাশ্মীরীরা ধারা বাতিলের এই সিদ্ধান্ত কে স্বাগত জানিয়েছে' বা 'কাশ্মীর দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে' - এধরণের মিথ্যা খবর ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচার চালিয়ে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের বক্তব্য মুছে ফেলার যে নোংরা প্রয়াস চালাচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, তাতে ওখানাকার মানুষ ব্যপক ক্ষুব্ধ। ইদগারেরর এক মহিলা জানান, "হামকো ইয়েসব সুননা পড়তা হ্যায়। অওর হামে জ্বলন হোতে হ্যায় ইয়ে সোচকে কি হাম হামারে বাতে কুছ ভি নেহি বোল পা রহে হে। (আমাদের এসব শুনতে হয়। আর আমাদের কষ্ট লাগে এসব ভেবে যে, আমরা আমাদের কোন কথাই বলতে পারছি না।)”
সপ্তাহের অন্যান্য দিন বিধিনিষেধ কিছু কিছু জায়গায় সামান্য শিথিল হলেও শুক্রবার দুপুর থেকেই গোটা উপত্যকা জুড়ে কারফিউ জারি থাকে। রাস্তায় অন্যদিনের চেয়ে ফোর্স আরোও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মানুষজন শুক্রবারের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যেতে পারেন না, বাধ্য হয়ে বাড়িতেই পড়েন। সেদিন আপদকালীন কোনো দরকারে বাইরে বেরোলে রাস্তায় চরম হেনস্থার মুখে পড়তে হয়।
গোটা কাশ্মীরের অর্থনৈতিক জীবন চরম বিপর্যস্ত। ছোটো বড়ো সমস্ত দোকান, মার্কেট সবকিছু বন্ধ। শুধু কিছু ওষুধের দোকান খোলা। এ সময় সোনমার্গ, গুলমার্গ, পেহেলগাঁও, ডালগেটের যেসব রাস্তা পর্যটকে ভরে উঠতো, তা এখন পুরোপুরি ফাঁকা। আপেলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা স্টোর করতে না পেরে রাস্তায় ঠেলাগাড়ি নিয়ে যদিওবা বসছেন, কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই।
৩৭০ ও ৩৫এ ধারাদুটি বাতিলের পর থেকেই কাশ্মীরে ডেভেলপমেন্ট হবে বলে এক অপপ্রচার চালানো হচ্ছিল। কিন্তু এটা যে কতটা কুযুক্তি সেটা ইকোনমিস্ট জঁ দ্রেজের সমীক্ষা থেকেই স্পষ্ট। সমীক্ষায় তিনি দেখিয়েছেন, মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটের থেকে জম্মু-কাশ্মীর কতটা ডেভেলপড্ জায়গা। উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোয় দারিদ্র্যের যে চরম দুর্দশা, তার চেয়ে কাশ্মীর কত এগিয়ে, কত উন্নত। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, কাশ্মীরে শ্রমিকদের দৈনিক আয় ৬০০-৮০০ টাকা, যা অন্যান্য রাজ্যের থেকে তিন-চার গুণ বেশি। অর্থাৎ তথ্য থেকেই পরিস্কার, এই ডেভেলপমেন্টের গল্পটি ভাঁওতা ছাড়া আর কিছুই নয়, বরং ডেভেলপমেন্টের নামে কাশ্মীরের সম্পত্তি আম্বানি আদানির মতো কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার এ এক জঘন্য প্রয়াস।
এই মুহূর্তে গোটা কাশ্মীর উপত্যকা আস্ত এক জেলখানায় পরিণত হয়েছে। যে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারাদুটি বাতিল করা হয়েছে এবং বিরুদ্ধমত প্রকাশ করলেই অবৈধ জুলুম চলছে সাধারণ মানুষের উপর তাতে মানবাধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। আমাদের করের টাকায় যেখানে লাখ লাখ সেনা মোতায়েন এবং যেখানে প্রায় প্রতিটি নাগরিক প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় নিপিড়নের শিকার তাতে আমরাও কি আমাদের দায় এড়াতে পারি? কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিবাদ জানানোর অধিকার, জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, সর্বোপরি মানবাধিকারের প্রশ্নে পাশে দাঁড়িয়ে দেশজুড়ে ব্যপক গণআন্দোলন গড়ে না তুললে, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ এতগুলি বছর যে নোংরা রাজনীতির শিকার তার বিরুদ্ধে সরব হয়ে কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের দাবিতে একজোট হয়ে আওয়াজ না তুললে কাশ্মীরের পরিস্থিতির উন্নতি তো কখনো সম্ভব নয়ই, বরং তা দিনের পর দিন চরম দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
লেখক: এক্টিভিস্ট ও কলকাতা বেথুন কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী।
সম্পাদক: শামীম আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক: এস এম মিজানুর রহমান মামুন, প্রকাশক: রাজন আকন্দ
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দেশেরবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম