কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে ধান কেনায় সরকারের নতুন পরিকল্পনা


দেশের কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ন্যায্য মূল্য ধান ক্রয় করার জন্য সরকার নতুন পরিকাল্পনা গ্রহণ করেছে। এজন্য ধান কাটার এক মাসে আগে তিন শ্রেণিতে কৃষকদের তালিকা করে তা প্রকাশ করা হবে। আর সেই তালিকা ধরে লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশ ধান ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে।
প্রান্তিক, মাঝারি ও বৃহৎ এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করে কৃষকদের তালিকা করা হবে। এরপর সেই তালিকা মোতাবেক কৃষকদের কার্ড বিতরণ করা হবে। ওই তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে এবং তালিকা ব্যবহার করে খাদ্য মন্ত্রণালয় ধান ক্রয় করবে। জাগো নিউজ’র এক বিশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
আগামী বোরো মৌসুম থেকে এ পদ্ধতিতে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান সংগ্রহ করা হবে। কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে এমন তথ্য জানা গেছে। এছাড়া কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে নানা উদ্যোগ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করছে বলেও জানা গেছে।
এবারের বোরো মৌসুমে কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। অবশেষে সরকার ভর্তুকি দিয়ে সারাদেশে ধান ক্রয়ের যে কর্মসূচি গ্রহণ করে সেখানে কৃষকের নয়, সিন্ডিকেটের ধানেই ভরে খাদ্যগুদাম এমন অভিযোগও আসে।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টদের এই সমসা সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দেন। এরপর কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক কৃষক-পর্যায়ে ধান-চালের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের অংশ হিসেবে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ বা প্রক্রিয়াকরণ, মিলারদের মাধ্যমে ক্রাশিং ও সংরক্ষণ এবং চাল রফতানির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন।
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে গত ৩০ জুলাই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) সম্মেলন কক্ষে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান ধানে কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে উদ্যোগের বিষয়ে বলেন, ‘আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ধান কাটার অন্তত এক মাস আগে তিন শ্রেণিতে (প্রান্তিক, মাঝারি ও বৃহৎ) কৃষকদের তালিকাভুক্ত ও কার্ড বিতরণ করা হবে। ওই তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে এবং তালিকা ব্যবহার করে খাদ্য মন্ত্রণালয় ধান কিনবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ময়েশ্চার মিটার দেব। ধানের আর্দ্রতা পরিমাপক যন্ত্রের (ময়েশ্চার মিটার) প্রাপ্যতা ইউনিয়ন-পর্যায়ে নিশ্চিত করা হবে। ময়েশ্চার মিটারের মাধ্যমে আগেই ধানের আর্দ্রতা পরীক্ষা করা হবে, কৃষকের ধানটা নেয়ার উপযুক্ত কি-না। অনেক সময় দেখা যায় কৃষক ধান নিয়ে গুদামে যায়, তখন দেখা যায় আর্দ্রতার জন্য ধান নেয়া যায় না। কৃষককে আবার কষ্ট করে ধানটা ফিরিয়ে নিতে হয়।’
এই সচিব আরো বলেন, ‘কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মিলগেটে বা হাট-বাজারে ধান সংগ্রহ করে মিলিংয়ের জন্য সরাসরি চালকলে ধান পাঠানো হবে। ধান কেনার আগে এলাকায় এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হবে। ধান কেনার সময় শতকরা ২০ ভাগ ধান বৃহৎ চাষী, ৩০ ভাগ ধান মাঝারি চাষী এবং ৫০ ভাগ ধান প্রান্তিক চাষীর কাছ থেকে কেনা হবে বলে আমরা সবাই একমত হয়েছি।’
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আগামী বোরো সিজনেই এগুলো করতে পারব। আগামী বোরো-কে সামনে রেখেই আমরা এগোচ্ছি।’
কৃষি সচিব আরো বলেন, ‘ফসলে কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে আমাদের যান্ত্রিকীকরণের দিকে যেতে হবে। এক্ষেত্রে প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা রাখছি আমরা। আশা করছি, এবার আমরা একটা ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণের দিকে যাব। তবে এজন্য কৃষককেও প্রস্তুত থাকতে হবে, তাকে তা গ্রহণের মানসিকতা ও সক্ষমতা থাকতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় চাল নয়, পুরো ধান কেনার পক্ষে। তবে নানা কারণে ধান কেনা যায় না। সমস্যা উত্তরণে আমরা যেসব উদ্যোগ নেয়ার নিচ্ছি, আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’
এ বিষয়ে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগামী বোরোতে যাতে কৃষক বঞ্চিত না হন সেজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার মাধ্যমে সবাই একমত হয়েছেন যে, কৃষককে স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ধান বিক্রির মাধ্যমে প্রাপ্ত কৃষকের অর্থ হতে ব্যাংক ঋণ কর্তন না করা। একই সঙ্গে বর্গাচাষীদের ঋণ সুবিধার আওতায় আনা।
তারা আরো জানান, আরো সিদ্ধান্ত এসেছে যে, সরকারি গোডাউনের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে ধানের উৎপাদন ও চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে সংগৃহীত ধান সরকারি গোডাউন ও মিলারদের গোডাউনে সংরক্ষণ করে ক্র্যাশিংয়ের ব্যবস্থা করা। কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা।
চাল রফতানির পরিমাণ ৫ থেকে ১০ লাখ টন ধরে রফতানি বাজার খোঁজা এবং চাল রপ্তানিতে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রপ্তানি প্রণোদনার তালিকায় চালের অন্তর্ভুক্তের বিষয়েও ঐকমত্য এসেছে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়।
কৃষককে ধান বা চালের ন্যায্য মূল্য দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিও গঠন করেছে সরকার। কমিটির আহ্বায়ক খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগ্রহ ও সরবরাহ)। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন- খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান বা প্রতিনিধি, কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক, ডিএই’র অতিরিক্ত পরিচালক (সরেজমিন উইং), রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং অর্থ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই, অটো রাইস মিল মালিক সমিতির পাঁচজন, চাল রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এবং তিনজন কৃষক প্রতিনিধি। খাদ্য অধিদফতরের পরিচালক (সংগ্রহ) এই কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
এ বিষয়ে খাদ্য সচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে আমাদের প্রচেষ্টা আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা কাজ করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কোন কোন কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনব তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন ঠিক করে দেয়। সেই তালিকাটা সঠিকভাবে করলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়। জনপ্রতিনিধিরা সতর্ক থাকলে যারা সুযোগ নেয় তাদের সেই সম্ভাবনা অনেক কমে যেতো। কোনো এলাকার অনিয়মের জন্য ওখানকার স্থানীয় লোকজনই দায়ী।’
‘আমরা সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আপসহীন। যারা অনিয়ম করছেন, জানতে পারলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। ধান-চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে আগামীতে কারও গাফিলতি পেলে আমরা তাকে ছাড় দেব না’- বলেন খাদ্য সচিব।
কৃষক ধান সংরক্ষণ করতে পারলে তো সে কম দামে বিক্রি করে দেবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সারা দেশের ২০০টি স্থানে পাঁচ হাজার টন ধারণক্ষমতার ধান সংরক্ষণের সাইলো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ সামনে রেখে আমরা কাজটি দ্রুত করার চেষ্টা করছি। আমরা এক থেকে দুই মাসের মধ্যে প্রকল্পটি একনেকে নিয়ে যাব। এরপর টেন্ডার হবে।’
খাদ্য সচিব আরো বলেন, ‘প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সব সাইলো একসঙ্গে করতে না পারলেও আপাতত ২০২০ সালের মধ্যে যদি কিছু করতে পারি, সেটাও আমরা দেখছি। সরকারি খাদ্যগুদামের মজুদের ক্ষমতা ২১ লাখ টনের মতো। তবে পুরনো হওয়ায় অনেক গুদামের কিছু অংশ ব্যবহার করা যায় না। তাই খাদ্যশস্য প্রকৃত মজুদের ক্ষমতা সাড়ে ১৯ লাখ টনের মতো দাঁড়ায়।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ধানের দাম কমার কারণে কৃষকরা ধান চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে অন্য ফসলে, যেমন উত্তরবঙ্গে ধানী জমি আম বাগান ও হাওরে মাছ চাষে চলে যাচ্ছে। যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি হতে পারে। সেচের জন্য বিদ্যুতে যে ভর্তুকি দেয়া হয় এর সুফল যেন কৃষকরা পান, সেটা দেখতে হবে। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক নজরদারি জোরদারের মাধ্যমে কৃষকের বিদ্যুতের ভর্তুকি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছর আমন মৌসুমে ধানের দাম কম ও দিনমজুর না পাওয়ায় ক্ষেতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। টাঙ্গাইলের ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সংসদও। দেশের বিভিন্ন স্থানে ধানের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন কৃষকরা। এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মনে করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
খাদ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ সংসদে তার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘আপনি কৃষকের সঙ্গে মশকরা করতে পারেন না। আপনি, আমি কৃষকের ভোটে, কৃষকের দয়ায় সংসদে এসেছি।’ পরবর্তীতে ক্ষেতে আগুন দেয়ার ঘটনা ‘সরকারের সুনাম ক্ষুণ্নের চেষ্টা কি-না, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।