2:53 AM, 13 March, 2025

পাপ পরিক্রমা – মারুনা রাহী রিমি

inbound3551546208121875511

সময় যতই যায়, একেকটা মানুষের জীবনের গল্পগুলো শুনলে বোঝা যায়, নিষ্ঠুরতা কোনদিন ছেড়ে যাবে না এই পৃথিবী ছেড়ে ঠিক যেমন মমতার কোন মৃত্যু হবে না। মিথ্যা বিজয়ীর সুরে অট্টহাসি হেসেই চলবে, সত্যও মুচকি হেসে প্রকৃতির হাতে সমর্পিত হবে। তখন প্রকৃতিই তার আদালতে বিচার করবে। কিন্তু এদের কারোই কোনদিন মৃত্যু হবে না।

এক আপা আমাদের ছোট্ট বাসাটায় কাজ করেন। তার জীবনের গল্পটা রোজই নানা ভাবে শুনি। মনে হয়, তার দুর্গতির হয়তো আল্লাহ কোন শেষ রাখেন নি। এক কালে স্বামী বিদেশ ছিলেন অল্প বয়সী বউ দেশে রেখে। দেশে ফিরেও ৩টা গাড়ি ছিল ভাড়ায় চালাবার জন্য। ৩ টা ছেলে। ছেলেদের কোরআনে হাফেজ বানাবার স্বপ্ন।

প্রায় ১০ বছর হলো স্বামী মরেছেন কিডনী নষ্ট হয়ে। কষ্ট করে চলতে গিয়ে ৩টা ছোট ছোট বাচ্চা কি করে পালবেন! দিশা না পেয়ে ভাল ঘরের মেয়ে ও বউ হয়েও লজ্জার মাথা খেয়ে ঢুকলেন গার্মেটস্ এ। ১ বছর কষ্ট করে বাচ্চাদের বড় করতে লাগলেন।

নিজের মান বাঁচাতে চাকরী ছেড়ে আবার ঘরে বসলেন। এরপর পেট চালাতে স্থানীয় হলেও অপরিচিত বাড়িতে লুকিয়ে কাজের লোকের কাজ করতে। আজও এলাকার বহু মানুষ জানে না উনি বাসা বাড়িতে কাজ করেন। নিজের সম্মান বজায় রাখতে আজও তিনি এই কাজের গোপনীয়তা রক্ষা করেন।

এভাবেই বড় ছেলেটার ২৪ পাড়া কোরআন মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। এমন একদিন কারেন্টে শক খেয়ে ছেলেটা মরে গেল। বুক ফাটা কষ্ট নিয়ে পরের ছোট ২ ছেলেকে মানুষ করতে উঠে পড়ে লাগলেন।

মেজো ছেলেটাকে একটা সরকারী চাকরী বা আর্মিতে দেবার জন্য অনেক চেষ্টা করতেন। এর মাঝেই গাড়ি চালানো শিখে সে চাকরী নিলো গাড়ি চালাবার। এর মাঝেই ৩ বছর ধরে প্রেমে জড়িত হয় বিবাহিত এমন একটা বিহারী মেয়ের যার কিনা নিজের ছোট ভাইয়ের মত একটা ছেলেও আছে।

নানা ভাবে মেয়ের চাপে পড়ে ছেলেটা বিয়ের জন্য নিজের মা কে বাধ্য করে মেনে নিতে যদিও তার মা কোনভাবেই রাজী ছিল না এমন মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নিতে। তবুও সন্তানের সুখের কথা ভেবে রাজী হলেন।

ছেলে নিজের পাই পাই করে জমানো টাকা মা এর অপারেশনের জন্যেও দেয় নি। অথচ সুন্দরী বিহারী মেয়ে বিয়ে করতে লোন করেও অনুষ্ঠান করলো, অনেক খরচ করলো এটা না জেনে যে, মেয়েটার আসল কাজই হলো এভাবে প্রতারনা করে ছেলেদের ফাঁসিয়ে বিয়ে করে মোহরানা নিয়ে চলে যাওয়া বা নিজেকে গুম করে পারিবারিক ভাবে ফাঁসিয়ে ছেলেদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করা।

বোকা ছেলেটা মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে আজও চেষ্টা করে চলেছে মেয়েটাকে আরও সুযোগ দিতে। অথচ বিয়ের এক মাসও যায় নি, মেয়েটা তার জামাইকে আলাদা বাসা নিতে বলেছে নিজের মা ভাই থেকে আলাদা হয়ে। এক মাসেই কয়েকবার বাপের বাড়ি চলে গেছে আর না ফেরার কথা বলে।

এরই মাঝে আপা একদিন ওকে কাগজপত্র গোছাতে দেখে। সুযোগ বুঝে উনি চেক করে দেখেন তার নিজের, ছেলের, বউ এর সবার আইডি কার্ড এর কপি। সে রোজই নানা বাহানা করে বাইরে যেত। আবার রাতে ফিরে আসতো।

আমার সন্দেহ হলো, এটা হয়তো মেয়েটার পারিবারিক ভাবেই কোন ব্যবসা হতে পারে। এভাবেই কোন কান্ড করে ফাঁসিয়ে দিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করার। আমি আপাকে বললাম একটা জিডি করে রাখতে। কেননা, যৌতুকের, নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসিয়ে মোটা ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে।

আসলেও তাই হলো। মেয়ে সব টাকা, গয়না, কাপর চোপর নিয়ে চলে গিয়ে নিজেকে গুম করে ফেললো। মোবাইল বন্ধ, পরিবারের সবাই জানায় তারা জানে না মেয়েটা কই। আমি আরও সিওর হয়ে গেলাম যে, এটা একটা ফাঁদ।

আপা আমার কথামত ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে গেলেন থানায় নিয়ে। থানা থেকে ফোন করে খোঁজ করে আসতে বলা হয় ওই মেয়ের পরিবারকে। ওদের পুরা প্ল্যান ভেস্তে গেল। শুনছি, এখন নাকি মেয়েটা তার জামাইকে হুমকি দিয়েছে তার নামে নারী নির্যাতন কেস করবে যদি ছেলেটা মোহরানার ৮০,০০০ টাকা না দেয়।

কষ্টের সাথে হাসিও পেল যে, যা সন্দেহ করেছিলাম তাই সঠিক হলো। আমার কথা মেনে থানায় গিয়ে এত বড় লোকসান হয়ে গেল মেয়েটার! আহারে। তবে মনে হচ্ছে, মেয়েটার একটা নয়, এমন আরও অনেক বিয়ে হয়েছিল ও এখনও এমন অনেক ছেলে সে ফাঁসিয়ে রেখেছে যাতে এই জামাইর হালাল করে আরেকটা হালাল করতে পারে।

আপা প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন এখন সে কি করবে। ছেলে নাকি মা কে লোন করে টাকা দিয়ে মেয়েটাকে ছাড়াতে বলছে। কিন্তু এটাও জানি, লোন করলে আপা নিজেই ফেঁসে যাবে। কারন, এই ছেলে মেয়েটার হাতের পুতুল। এক নিমিষেই বউ এর কথায় পটে গিয়ে ছুটে যাবে। আপার ৮০,০০০ হাজার টাকাও যাবে, আর ছেলেও যাবে।

আরেকটা ছেলেও হচ্ছে একই পথের পথিক। সেও হয়তো এমনই কোন একটা কান্ড ঘটাবে আর আপার জীবনের দুর্গতি আবারও একের পর এক বেড়েই চলবে যেমন চলছিল…..।

ভেবেছিলাম ভাল করতে থাকলে কেউ আমাকে কি করে খারাপ বলতে পারবে বা বানাতে পারবে! দিনের পর দিন একেকটা ঘটনা আমাকে শিখেয়ে যায়, তুমি যত ভালই করো না কেন, মানুষের মানসিকতা, ভাষায়, মিথ্যায়, গুজবে, রটনায় কোনদিনই নিজেকে ভাল বানাতে পারবে না। এই মিথ্যা জগৎ, মিথ্যা সমাজ, মিথ্যা মানুষগুলো তোমাকে ঠিকই খারাপ প্রমান করে দিয়ে যাবে।

তাই এখন নিশ্চিত বুঝে গিয়েছি, কিছু মানুষ মিথ্যা নিয়েই বেঁচে থাকবে, মিথ্যা নিয়েই মরবে, মিথ্যার জন্য আল্লাহর দেয়া শাস্তিও ভোগ করবে, তবুও কোনদিন মিথ্যাকে ত্যাগ করবে না। তাদের জীবনে মিথ্যা, অন্যের নামে বদনা, গীবত, রটনা বানানো থাকবেই। এরা শাস্তি পেলেও বুঝবে না যে শাস্তি পাচ্ছে। এদের মাঝে কোনদিনই অনুশোচনা কাজ করবে না।

যাই হোক, আমার ভাবনায় ও বিশ্বাসে বহু বারই ফাটল ধরেছিল। সত্যের পরাজয় অসংখ্যবার হতে দেখেছি। মিথ্যাকে বিজয়ের হাসি হাসতেও দেখেছি। তবে একটা উপহার সত্য আমাকে বরাবরই দিয়েছে, আত্মার শান্তি ও স্বাধীনতার স্বাদ। মিথ্যা দিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার মত কাজ হয়তো বোকারাই করে।

কেননা, যাকে বদনাম করে, সমাজে অসম্মানিত করে মনে করছি সব হাসিল হয়ে গেল, আদৌ কি তাদের হৃদয় পরিপূর্ণতা পেয়েছে, শান্তি পেয়েছে? তারা যা করছে, তাদের হৃদয় জানে মিথ্যা ও খারাপ করছে।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তারা আমাদের মানে যাদের নামে বদনাম, গীবত, রটনা, মিথ্যা ইত্যাদি চালিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা মূলত আমাদেরকে জান্নাতের দুয়ারে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে আমাদের সম্মানহানি করতে গিয়ে আল্লাহর কাছে আমাদের উচ্চ মর্যাদাপূর্ন স্থান গড়ে দিচ্ছে। এইজন্যে আমাদের উচিত তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া।

আমি আজ মন থেকে সত্যিই আমার স্বামী, শাশুরী, ননদ, ভাসুর, খালা শাশুরী, তাদের কন্যাদের ও আমার আপন ভাই, ভাবী ও অন্যান্য আত্মীয়দের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ যারা আমাকে নিয়ে মিথ্যা, রটনা, গীবত ছড়িয়ে আমাকে বদনা, অসম্মান করার চেষ্টা করতো, করে বেড়াচ্ছে ও আগামীতেও বেড়াবে। ওদের জন্যেই যদি আমার অসংখ্য পাপ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আমিন।

কেউ যখন আমাকে বুঝ দেয়, “ছি ছি, মানুষের সাথে এমন করে না, কাউকে কষ্ট দিতে নাই, স্বামীর সাথে এমন আচরনে পাপ হয়! ইত্যাদি ইত্যাদি।”

বরাবরই আমি নিজের দায় দায়িত্ব পালন করে চুপ মেরে যেতাম। আমার প্রতি দায় দায়িত্ব বরাবরই সবাই ভুলে থেকেছে, কষ্ট দিয়েছে সীমাহীন, অন্যায়ের পর অন্যায় করেছে, চোখের পানির বন্যা বইয়ে ছেড়েছে এমন একটা মেয়ের যে কিনা সহজে কাঁদে না, কোনদিনই কাউকে বিন্দু পরিমানও অনুশোচনা করতে দেখি নি।

রাতের পর রাত তাহাজ্জুদ নামাজে বসে মোনাজাতে জান প্রাণ দিয়ে কাঁদতে দেখে নি, কেউ কোনদিন বাথরুমে বসে ফুপিয়ে কেঁদে মুখ ধুয়ে আসা খেয়াল করে নি, কেউ কোনদিন আমার গায়ের ছেড়া- রংচটা- ময়লা জামাটা খেয়াল করে নি, কেউ খেয়াল করে নি আমি পা ফুলে পায়ের ব্যথায় খুড়িয়ে হাঁটছি, কেউ দেখে নি আমার শরীরে হিমোগ্লোবিন- পটাসিয়াম- ভিটামিনের ঘাটতিতে হাত- পা অবশ হয়ে আসে, ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ে, কেউ কখনও খেয়াল করে নি দিন-রাত নির্ঘুম ও পরিশ্রম করে করে বাথরুমে বসে আমাকে একটু জিরিয়ে নিতে হতো বহুদিন, কেউ দেখে নি আমার শরীর দিন দিন অসুস্থ ও দূর্বল হয়ে পড়তো পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় খাবার ও পুষ্টির অভাবে, কেউ খেয়াল করে নি আমাকেও ডাক্তার দেখাতে হবে, ওষুধ খাওয়াতে হবে, মাসে মাসে ছোট বড় অনেক প্রয়োজন থাকে।

কেউ খেয়াল করে নি আমারও ঘুড়ে বেড়াতে মন চাইতে পারে, আমারও মাঝে মধ্যে ভালমন্দ বা বিশেষ কিছু খেতে মন চাইতে পারে, আমারও মন চাইতে পারে অন্য মেয়েদের মত নিজেকে একটু সাজাতে, নিজের বিশেষ রূপচর্চা করতে, নিজের বিশেষ যত্ন নিতে, আমারও মন চাইতে পারে বিশেষ দিনগুলোতে আমাকেও কেউ অন্য ভাগ্যবতীদের মত উপহার দিক, সারপ্রাইজ দিক, বিশেষ বলে ট্রিট করুক। আমারও মনে হতে কেউ আমাকে সত্যিকারের ভালবাসুক, টাকা পয়সা বা বাড়ির বিনিময়ে নয়। আমারও মন চাইতে পারে মন ভরে কারো সাথে কথা বলতে, চ্যাট করতে, সব শেয়ার করতে। আমারও মনে হতে পারে যে, আমার জীবনটা শুধু দায়িত্ব, কাজ, খাওয়া, ঘুম, মানুষের সেবা, বাচ্চা পালা, ত্যাগ করা, অভাবে জীবন যাপন করায় সীমাবদ্ধ না থাকুক।

কিন্তু এমন একটা মানুষ এই পৃথিবীতে নেই যে কিনা আমাকে এভাবে আগলে রেখেছে, ভালবেসেছে, আমাকে বুঝেছে, আমার খেয়াল রেখেছে। সবার শুধু একটাই আশা, আমাকেই মহানুভবতা দেখিয়ে মহামানবী হয়ে বেঁচে থাকতে হবে যার কোন অনুভূতি থাকবে না, প্রয়োজন থাকবে না, চাহিদা থাকবে না, নিজস্বতা থাকবে না, আত্ম সম্মান থাকবে না। যে শুধু মেনে নিবে, মানিয়ে নিবে, বাদ দিবে, করে যাবে, ত্যাগ করবে, সমঝোতা করবে। যার কোন কষ্ট হবে না, ব্যথা থাকবে না, ক্ষুধা লাগবে না, কিছুর প্রয়োজন থাকবে না। মোট কথা, একটা রোবট হয়ে থাকবে।

মানুষকে এটাই বোঝানো যায় না যে, একটা মানুষ কি করে রোবট হতে পারে!

আজ আমার ক্ষেত্রে যদি ধর্ম বা আইন নিয়ম গড়ে তোলে তবে অন্যদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আমাকে কষ্ট দিয়ে, কাঁদিয়ে যদি অন্য কারো পাপ না হয় তবে অন্য কারো ক্ষেত্রেও আমার কোন পাপ হবে না। আমার দায় দায়িত্ব পালন না করে অন্যরা যদি পাড় পেয়ে যায়, তবে আমিও কারো দায় দায়িত্ব পালনে বাধ্য নই। অন্যদের যদি কেউ কিছু বলতে না পারে তবে আমাকেও কেউ কিছু বলার অধিকার রাখে না।

পাপ হলে উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যদি অন্যদের পাপ না হয় আমার সাথে অন্যায়ের পর অন্যায় করে, তবে আমারও হবে না। লাথি মারি যারা শুধু আমাদের মত মেয়েদের জন্যেই ধর্মের নিয়ম বেধে দিয়ে বাধ্য করে সব কিছুতে।

মারুনা রাহী রিমি, লেখক ও কলামিস্ট। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *