শ্বাশুড়ি পূরাণ – মারুনা রাহী রিমি


অনেক মেয়েদেরই দেখি শ্বাশুড়ি বদনাম নিয়ে চুটিয়ে গল্প করতে। সত্যি বলতে আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। কষ্ট পেয়ে লিখেছিলামও অনেক। আজ কিছু ভাল কথা বলতে মন চাচ্ছে।
একটা সময় ছিল, যখন আমার কাছে শ্বশুড়বাড়িতে শ্বাশুড়ি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কোন জীব। আজ না হয় নাই বা বলি কেন এত ভয়ঙ্কর ছিলেন। সেই সময় আমার তাকে এমনই ভয়ঙ্কর মনে হতো যে, অনেকবার মনে হয়েছে মায়ের মত করে একটু জড়িয়ে ধরি। এখানে তো উনিই আমার মা। কিন্তু ভুল করেও পারতাম না। সেই সুযোগই উনি দিতেন না।
ঈদে বা বাসায় আসার সময় বা বাসা থেকে ফিরেই মনে হতো শ্বাশুড়ি বা ননদকে একটু জড়িয়ে ধরি। কিন্তু সম্ভব হতো না। আসলে মানসিকতা এখানে অনেক বড় বিষয়। আপনি যদি মিশুক ধরনের হন তবে হাসি দিয়ে হাত বাড়ালেই বুঝে যাবেন যে, ভালবাসা আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আপনি কোলাকুলি করবেন। কিন্তু আপনি ভয়ঙ্কর টাইপের হলে হাসিমাখা মুখ দেখেও নাক উচকে মুখ ঘুড়িয়ে নিবেন।
এখন আমার শ্বাশুড়ি শয্যাশায়ী। নিজে থেকে উনি কিছুই করতে পারেন না। সহজে কথাও বলেন না। ২/১ টা কথা বলেন ও কিছু জানতে চাইলে সেন্স থাকলে মাথা নেড়ে জবাব দেন। উনাকে সর্বক্ষন অন্যের দেখাশোনায় থাকতে হয়।
কয়েক মাস সুযোগ হয়েছিল উনার সেবা করার। উনি এখন একদম বেবিদের মত হয়ে গেছেন। মজার বিষয় হল, আগের মত তাকে আমার ভয়ঙ্কর লাগে নি। বরং মনে হতো, উনি আমার মা নয়, মেয়েই হয়ে গেছেন। মন থেকেই আমি আমার মেয়ের মত করেই বড় মেয়েটার যত্ন নিতাম মায়ের মত। এবারই হয়তো আমার সুযোগ হয়েছিল শ্বাশুড়ির মেয়ে হবার।
এবার উনি আমার ভালবাসা যেমন বুঝতেন, তেমনই তার জবাবও দিতেন। অন্যদের এভাবে জবাব দেয়ার সুযোগ হয়তো পেতেন না। কারন সবাই বিজি। দৌড়ের উপর সব করতো, তাড়াতাড়ি করতো, তার ব্যথা, বেদনা বা ইচ্ছা- অনিচ্ছা পাত্তা না দিয়েই কাজ করতো। ওই বাসায় এক আমিই হয়তো ছিলাম যে, শাশুরী মা কি খাবেন জানতে চাইতাম তার কাছেই, কোন আঙুল থেকে রক্ত নিবো ডায়াবেটিস মাপতে সেটাও জিগাসা করতাম, ব্যথা পেলে বা কষ্ট হলে জড়িয়ে ধরতাম, বাসায় আসলেও জড়িয়ে ধরে আদর করে যেতান।
কয়েকদিন আগে মিথ্যা বলে আমার স্বামী তাদের গোডাউন প্লাস বাংলোবাড়ীতে নিয়ে যায় যেখানে ওর পরিবারের সবাই পিকনিক করে। শাশুরী মা কেও হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যায়। আমি জড়িয়ে ধরে সালাম দেয়ায় উনি যেন অনেক তৃপ্তির সাথে সালাম নিলেন। আগে কোনদিন তার এত খুশি দেখি নি আমাকে দেখে। বিশেষ করে সুস্থ থাকতে।
বিকাল হতে হতে সবাই যখন নানা কাজে বিজি হয়ে পড়ে তখন খেয়াল করে নি উনার খুব ঠান্ডা লাগছে কম্বল, কাঁথা, চাদরে মুড়ে থেকেও। মারাত্মক কাঁপছিলেন। আমি গিয়ে দেখি হাত পা ঠান্ডা। আমি হাত গরম করার চেষ্টায় উনার হাত ধরলাম। প্রাণপনে উনি আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। কারন উনি বলতেও পারছিলেন না তার কত কষ্ট হচ্ছে। পরে আমি গিয়ে সবাইকে বলায় তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন।
সেই সময়টা আমি অনুভব করলাম, উনিও আমার ভালবাসার ছোঁয়া কতটা বোঝেন এখন।
মজার বিষয় হলো, ওই বাসায় আমার আপন বলে কাউকেই মনে হয় না। স্বয়ং আমার স্বামীকেও না। কিন্তু এখন মনে হয়, ওই বাসায় সবচেয়ে আপন যদি আমার কেউ থেকে থাকে তবে একমাত্র উনিই (আমার শাশুরীমা)। আগে হলে বুঝতাম স্বার্থের জন্য আপন। কিন্তু এখন উনার মনটাই আমাকে সরাসরি আমার মনের সাথে যোগাযোগ করে। উনি মুখে কিছু বলতে বা বোঝাতে তো পারেন না। তাই হয়তো আগের থেকে বেশি উনাকে বুঝতে পারতাম।
জানি না আল্লাহ উনাকে কতদিন এভাবে ভুগাবেন। তবে দোয়া করি আল্লাহ উনাকে নেক হায়াত দান করুন। অন্তত এতটুকু সেন্স যাতে দেন যেন উনি শুয়ে হলেও নামাজ ও আল্লাহর ইবাদত করতে পারেন মনে মনে। আর যদি কোনদিন আল্লাহর কাছে যান ই, তবে যেন সকল পাপ তার এই কষ্টের মাধ্যমে শেষ করে নিষ্পাপ হয়েই জান্নাতবাসী করেন। শেষে হলেও উনার মুখ ও মন যেন পবিত্র হয়ে কালিমা পড়ে শেষ হন। আমিন!