বৈধব্য, চারকেলে - পৃথা চক্রবর্তী
১. মায়ের মুখাগ্নি করতে করতে হৃদিরঞ্জনের মনে হচ্ছিল, বাপের মুখাগ্নি ও যদি করতে পারতেন একইসঙ্গে, কিন্তু সহমরণ তো একচেটে নারীর জন্যই। নাঃ, পারেননি তিনি, একমাত্র শিশু বোনটিকে পুড়িয়ে মারার হাত থেকে বাঁচাতে। পাঁচ গাঁয়ের মধ্যে একখানা থানা থেকে লোক আনতে আনতে তাঁর বাবাই নিজে উদ্যোগ আয়োজন করে পুড়িয়ে মেরেছে শিশু আত্মজাটিকে। তাতে ধর্ম রক্ষা হলেও তাঁর মায়ের প্রাণটি রক্ষা পায়নি। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে তাঁর, যেমন টা তাঁর মার কপালখানাও, রক্তে আর সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে।
২. স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন বিধুশেখর। তারপর আস্তে আস্তে মেজ মেয়ের হাত ছেড়ে নিজের হাতের পুটুলিটি তোরঙ্গের ওপর রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কপাল চাপড়ে মুখে আঁচল গুঁজে কেঁদে চললেন কুমুদিনী। বড় সাবিত্রী গত বছর চলে গেছে এক একাদশীর দিনে, শুধু জল তেষ্টায়। আজ তাঁর স্বামী তাই নিয়ে যাচ্ছিলেন মেজ সীতাকে, কলকেতায় নাকি বিধবা বিবাহ চালু করেছেন কোন টুলো পন্ডিত। কিন্তু তাঁদের যে আরো দুটি মেয়ে আছে, আছে তিন ছেলে, বিধবা পিসতুতো ননদ, আছেন শ্বশুর। সবই তো ঐ পুরোহিত গিরির ওপর ভরসা করে। একঘরে করে রাখলে এত গুলো প্রাণী যায় কোথায়? সীতা মার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন মার চোখের জল মুছিয়ে ঘরে নিয়ে চললো, সংসারের কাজ বিস্তর।
৩. এমন কিছু বয়স হয়নি রমলার, যে সাদা কাপড় পরে, আমিষ ছেড়ে, সব বাসনা কামনা বাদ দিয়ে বাঁচতে হবে। কিন্তু ঐ যে, বাড়ির বড় বউ, শ্বশুর নিজে পছন্দ করে এনেছিলেন তাঁকে। বাপ মা মরা বন্ধু কন্যাকে বিনা পণে ই শুধু নয়, উল্টে নিজেই এক গা গয়না দিয়ে সাজিয়ে। পরেও আগলে রাখতেন মুখুজ্যে মশাই। স্বামী অবশ্য সংসারে উদাসীন ছিলেন, যদিও পারিবারিক ঐতিহ্য তাঁর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল। আজ সেই ঐতিহ্য কি করে বা ভাঙবেন তিনি, এত বড় বংশের বড়বউ হয়ে? কেউ জোর করলে তিনিও হয়তো খানিক স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেন। সত্যি ফিরতেন কি? ধন্দ লাগে, মন ও যে তৈরি হয়ে গেছে সেই পুরোনো ধাঁচে। কিন্তু চেষ্টা ও তো কেউ করেনি।
৪. দক্ষিণের ঝুল বারান্দায় বসে কফির কাপ হাতে খানিক আনমনা হয়ে যাচ্ছেন রুষা। এই জায়গাটা তাঁদের দুজনের অবসর কাটানোর জায়গা। আজ কদিন পর সত্যি একেবারেই একা। হয়তো মনে মনে চাইছিলেন ও, একটু একা হওয়া বড় প্রয়োজন মনে হচ্ছিল, ঋজুর সঙ্গে , ঋজুর চিন্তা, তাঁর স্মৃতির সঙ্গে একান্ত হওয়ার জন্য। মাত্র ২০ বছরের বিবাহিত জীবন তাঁদের, যদিও সম্পর্ক একইসর। স্কুল থেকে একসঙ্গে, পরে উচ্চশিক্ষায় আলাদা হলেও ততদিনে দুজনে চিরকাল একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। 'চিরকাল', একচিলতে বিষন্ন হাসি ফুটে উঠলো রুষার মুখে, কি আজব এই শব্দটা। বেল বাজতে উঠে দরজা খুললেন, ভাইঝি এসে রাতের খাবার দিয়ে গেল। "সময়ে খেয়ে নিবি রাঙা, ঠাম্ নইলে আমাকেই বকবে"। মাথার চুল টা হাত দিয়ে একটু ঘেঁটে দিলেন তার। "সাবধানে যাবি কিন্তু, বাইক আস্তে চালাবি মুমু", হেসে পালালো মেয়েটা। একটু পরেই ফোন এল, মা, "খেয়ে নে আগে"। "খাচ্ছি মা' । আবার ফোন, "বৌদি, কী করছো, রাত কোরোনা, খেয়ে শুয়ে পড়ো, আর ওষুধ গুলো খেয়ে নাও প্লিজ।" দেওর বরাবরই কেয়ারিং, ম্যাচিওর। ঋজুর মত ছেলেমানুষি তার পোষায় না, বেপরোয়া ও নয়, তাই হুট করে পুত্রশোকাছন্ন মা বাবাকে সেই সামলে রেখেছে এখন। আবার মা, "খেলি, এরপর ঠাণ্ডা হলে খেতে পারবি?" "বসছি মা" বসেই পড়লেন খেতে। মাছের ঝোল, ভাত, আর মাছ ভাজা। মাছ ছাড়া খাবার রোচে না তাঁর। কিন্তু, কিন্তু.... আজকাল কোনকিছুতে ই রুচি হয়না। সব ভালোলাগা, ভালোবাসা যেন এই বাড়ির মতই ফাঁকা লাগে, ফিকে লাগে। গ্রাস তুলতে গিয়ে আনমনা হয়ে গেলেন আবার। আজকাল আর কেউ বৈধব্যে আমিষ ছাড়ে না, বেরঙ হয়না। তিনি নিজেই তো এনিয়ে কতজনের জন্য বলেছেন, টুকটাক সমালোচনা কানে গেলেই। কিন্তু অন্দরমহলে, অনেক গভীরে কোথাও খানিকটা ফাঁকা হলে যে বাহ্যিক আয়োজনে কিছু ফারাক হয় না, এটা তিনি জানতেন না। জীবন অবশ্য টেনে নিয়ে যাবে ই তার স্রোতে, কিন্তু মনের মধ্যে ঘড়ির মত কিছু কষ্ট টিকটিক করবে 'চিরকাল'।
সম্পাদক: শামীম আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক: এস এম মিজানুর রহমান মামুন, প্রকাশক: রাজন আকন্দ
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দেশেরবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম