5:05 AM, 13 November, 2025

কাঁচের হীরে – মারুনা রাহী রিমি

FB_IMG_1626801351236

মহিম তার নতুন বউ বিভাকে নিয়ে বাইরে ঘুড়তে বের হয়েছে। সে নতুন বউ নিয়ে খুব খুশি। অনেক সুন্দর বিভা। কি সুন্দর ফিগার, ধবধবে ফর্সা, সে কি মায়া মায়া চেহারা! শুধু দেখতেই মন চায়। আগের বউটা কি কুৎসিত ছিল। কালো, এই মোটা, ভুরী ছিল, তার মধ্যে একটু খুড়িয়ে হাটে। বাড়ীটা না থাকলে ভুলেও সে এমন মেয়ে বিয়ে করতো না। সাথে নিয়ে কোথাও যেতেও মহিমের লজ্জা হতো। এখন সে বুক ফুলিয়ে সুন্দরী বউ নিয়ে বের হতে পারে।

সময়ের সাথে সাথে মহিমের নেশা কাটতে শুরু করলো। বিভা এত সুন্দর যে, কোন পুরুষই না তাকিয়ে থাকতে পারে না। বিভাও যেন এসব খুব উপভোগ করে। কখনও পুরুষদের সাথে এত ফ্রি হয়ে হেসে কথা বলে যে, মহিমের খুব খারাপ লাগে। মনে পড়ে যায় মহিমের, স্মৃতি(মহিমের আগের বউ) এমন ছিল না। সে সবার সাথে হেসে কথা বলা বা ভাল ব্যবহার তো করতো, কিন্তু এমন গা ঘেসাঘেসি, মাখামাখি বা বেশি বেশি কখনও করতো না।

বিভাকে বাড়িতে তুলেছে ৩ দিন হয়ে গেল। বিভা যেন ঘর থেকেই বের হতে চায় না। মহিম কত বুঝালো সবার সাথে গিয়ে মিশতে। বিভার কানে যেন কথাই গেল না। মহিম ভাবলো, বিভা বুঝি নতুন মানুষ বলে লজ্জায় এমন করছে। তাই ওকে সহজ করতে মহিম সকাল ৭টায় ঘুম থেকে তুলে বুয়ার সাথে গিয়ে রুটি সেকতে বলল।

বিভার মন খুব খারাপ। কথা বলছে না। হঠাৎ বিভার বাবা ফোন করলেন, “আমি কি তোমাকে কাজের লোক দিয়েছি যে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিয়ে তুমি আমার মেয়েকে দিয়ে বুয়ার কাজ করাও? আমার মেয়ে কোনদিন ১২টার আগে ঘুম থেকে উঠে নি, পানিটাও ঢেলে খায় নি। আর ওকে দিয়ে তুমি রুটি সেকাও, অর্ডার করো এটা ওটা করতে? আবার রুটি ঠিক মত ভাজা হয় নি বলে খোটাও দেও! এত সাহস হয়ে গেছে তোমাদের? আর কোনদিন আমার মেয়েকে নির্যাতন করবে তো আমি তোমার নামে কেস করে দিবো।”

মহিম পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। বিভা কাজ সেরেই তার মা বাবার কাছে ফোন করে নালিশ করেছিল। এমন কিছু হবে সে কখনও কল্পনাও করে নি। বিভাকে পরিবারে সহজ করতে গিয়ে নিজেই এত কঠিন করে ফেলবে পরিস্থিতি সে ভাবতেও পারে নি।

হঠাৎ মহিমের চোখে পানি এল। কাবিনের দেড় বছর পর সে স্মৃতি কে ঘরে তুলেছিল। স্মৃতি হাসি মুখে পরের দিন ভোরে উঠেই সেজে গুজে শাড়ী পড়ে শাশুরীকে সালাম করে একাই রান্না ঘরে গিয়ে বুয়ার সাথে রুটি সেকে সবার জন্য চা নাস্তা বানাতে সাহায্য করছিল, ঘরের টুকটাক কাজ করছিল। কাজের সমস্যা হবে ভেবে শাড়ী বদলে সেলোয়ার-কামিজ পড়ে কাজে লেগে গিয়েছিল। তার মাথায় না বিরক্তির ছোয়া ছিল, আর না ক্লান্তি। ওকে কিছুই বলতে হয় নি। বড় ঘরের মেয়ে সেও ছিল। কিন্তু কখনও তা দেখায় নি।

এখন বিভাকে কোন কাজ করতে বলতে মহিম ও তার পরিবারের সবার ভয় হতে থাকলো। কারন বিভার বাবা মা স্মৃতির মায়ের মত এত সহজ সরল ভাল মানুষ ছিল না যে মেয়ের কষ্ট দেখেও হজম করে যাবেন। ওকে কিছু বললে উল্টো ফেঁসে যাবে।

বাচ্চাগুলো বিভার ঘরে এসে দুষ্টুমি শুরু করলো। বিভার বিছানায় বসিয়ে মহিম টিভি ছেড়ে খাওয়াতে লাগলো। এরপর বিভা অনেক বিরক্ত হলো। সেই রাতে বিভার মহিমের সাথে অনেক ঝগড়া হল। বিভার বিছানা নষ্ট করেছে, নোংরা করেছে বাচ্চারা। মহিমও তাদের ভালবাসায় মাথায় তুলে রাখছে। এভাবে হবে না!

মহিমের মন ভেঙে গেল। মনে পড়ে গেল স্মৃতি কি আদর ভালবাসা দিয়ে বাচ্চাদের নিজের বিছানায় বসিয়ে নাস্তা করাতো, টিভি ছেড়ে দিতো, বাচ্চাদের সাথে খেলতো। বাচ্চারাও পুরো দিন ওই ঘর থেকেই যেতো না। পুরো দিন স্মৃতির বাচ্চাদের নিয়েই কাটতো।

মহিমের কাছে টাকা ছিল না। বিভার কাছে ১০০০ টাকা ধার চাইলো। বিভা রেগে গেল ও বলল, “সব টাকা যখন মা কে দিয়ে দাও, মায়ের কাছ থেকেও নাও গে। আমার কাছে টাকা নাই।”

এতটা অপমানিত সে কোনদিন ফিল করে নি। মুখটা ছোট করে ঘর থেকে বেড়িয়ে খালি পকেটেই হেটেই শোরুমে চলে গেল। এবার স্মৃতিকে সে খুব করে মিস করতে থাকলো। কেননা, সে বেকার, তার টাকা পয়সা কিছুই নাই নাই জেনেও স্মৃতি তাকে বিয়ে করেছিল। ওরা সবাই বলেছিল, মেয়েটা হয় অনেক বেশি বোকা, নইলে অনেক বেশি ভাল। কাবিনের পর থেকে ধারের নামে কত শত টাকা যে সে স্মৃতির কাছ থেকে নিয়েছে তার হিসেব নেই। দুনিয়ার বিলাসিতা, লোকের কাছে শো অফ ইত্যাদির জন্যেও স্মৃতির সামান্য জমা টাকাও শেষ করে ফেলেছিল।

আজ বুঝতে পারলো সে কি হারিয়েছে। সেই মেয়েটা অভাবের সময় তার পাশে এসে হাত ধরেছিল। কোনদিন কিছুই চায় নি, বিবেক বুদ্ধিহীনদের মত সে ও তার পরিবারও কিছুই দেয় নি। কখনও আক্ষেপ করতো না তার যদিও মানুষের কাছে ছোট হতে হতো স্মৃতিকে। কারন সবাই কাবিন, বিয়ের অনুষ্ঠান, ঈদ বা যেকোন ওকেশনে জামাই বা শশুরবাড়ী থেকে কি দিয়েছে জিজ্ঞাসা করলে জবাব দিতে পারতো না।

বিভাকে ভরে ভরে দিতে হয়েছে। তাও তার চাহিদার শেষ নাই। এটা চাই, ওটা চাই, শপিং শপিং আর শপিং। এখন তো মহিমের মা আড়ালেই বিভাকে গালি গালাজ শুরু করেছে। কেননা, বড় ঘরের সুন্দরীও তাদের চাহিদা ছিল, আবার ফ্রি কাজের লোকও লাগতো। বিভা বড় ঘরের সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু কাজের লোক হতে সে পারবে না।

মহিমের হাত পায়ে খুব ব্যথা হলেও বলতে পারতো না বিভাকে। কে জানে আবার বুঝি তার বাবা মা কে বিচার দেয়। মহিমের তাই খুব করে স্মৃতি কে মনে পড়ছে। স্মৃতি কোনদিন মহিমকে তার হাত পা শরীর টিপে দিতে মানা করতো না নিজের হাত কাটা বা ব্যথা থাকলেও, রাক্ষসের মত নোংরা ভয়ংকর নখ দেখেও ঘেন্না করে নাক উচকাতো না। বরং পরম ভালবাসা দিয়ে যত্ন করে ঘন্টা খানেক কষ্ট করে হলেও কেটে দিতো।

সবচেয়ে কষ্ট লাগলো মহিমের যখন বিভা মহিমের পরিবারের আগে নিজের ও তার পরিবারের কথা ভাবতে লাগলো। মহিমের ভাল ভাল খাবার৷, ভাল ভাল জিনিস সবার সামনে এনে লুকিয়ে রাখতো, একা খেতো, একা পড়তো। তখন মনে পড়ে যেতো, স্মৃতির বাড়ী থেকে কিছু আসলে, বা কোন খাবার রাঁধলে, খাবার আনলে পরিবারের সবার সাথে শেয়ার করতো। সবারটা আগে দেখতো, তারপর নিজেরটা। একা নিজের কথা সে ভাবতেও পারতো না।

বিভা একবার বলেই ফেলল, “তুমি কিছুই পারো না। তুমি একদম পারফেক্ট নও।” লজ্জায় বিভার দিকে সে তাকাতেও পারে নি। চোখে পানি চলে এসেছিল। স্মৃতির কথা মনে পড়লো। সে কখনও ওকে ছোট হতে দেয় নি। বরং ভালবাসা দিয়ে উৎসাহ দিয়ে বোঝাতো।

এবার আরও ভাল ভাবে মহিমকে বিভা বুঝিয়ে দিল, সব মেয়েদের এত সস্তায় বঞ্চিত করে সংসার কখনও সম্ভব হয় না।

৩ মাস পর ঈদের পরের দিন বিভার বাবা মা এসে বিভাকে নিয়ে গেল। কারন বিভাকে প্রথম ঈদে দামী কাপর, জুতা, কাসমেটিক কিছুই দেয়া হয় নি। এমন কি বিভার পরিবারকেও কিছু দিতে পারে নি। বিভাকে ১০টার মধ্যে ঘুম থেকে তুলে দেয়, নিজের খাবার নিজেকে রান্না করে খেতে হয়। ওদের বাসায় সবাই নোংরা গালি গালাজ করে। বিভাকেও নাকি মহিম ও তার শাশুরী নোংরা গালি দিয়েছে। তাই বিভা দরজা আটকে ঈদের আগের দিন থেকে না খেয়ে কেঁদেছে। তাই সে থাকবে না এই বাসায়।

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। বেশি লোভ করে আরও ভাল পেতে গিয়ে সবচেয়ে ভাল জিনিসটাই হারিয়ে মহিমের চোখে আজ পানি। তার মনে পড়ে গেল, স্মৃতি কতটাই না সহ্য করেছিল। কোনদিন টের পায় নি মহিম। বিভা ওকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, কয়লা ভেবে হীরা টা ফেলে দিয়েছিল। আর হীরার মত চকচকে কাচটা বেছে নিয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *