সফিকুল ইসলাম শরীফ এর দর্শন “পল্লীবালার ইদ”

পল্লীবালার ইদ
মো: সফিকুল ইসলাম শরীফ
ইদ মানে আনন্দ। ইদ মানে অন্যের সাথে নিজের খুশিকে ভাগ করে নেয়া। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান এই পবিত্র ইদ। সর্বস্তরের মুসলমানরা সেদিন নিজেদের সাজায় নতুন রূপে, নতুন সাজে। পথে-ঘাটে যেখানেই চোখ যাবে আনন্দের জোয়ার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সেদিনও অনেকেই দিন কাটায় ভালো খাবারের পরিবর্তে দু-গ্লাস পানি দিয়ে। দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারটি সন্তানদের মুখে ইদের আনন্দের ভুবনভুলানো হাসি দেখায় প্রত্যাশায় তিল তিল করে যোগাড় করা সারা বছরের সঞ্চয় দিয়ে কিনে দিতে হয় তাদের জামা কাপড়।
সামান্য একটু মিষ্টান্নের ব্যবস্থা করলেও সন্তানদের জন্য তাও উৎসর্গ করে দেয় হাসি মুখে। ইদের দিনও বাবা পরের বাড়িতে মজুরি কাটে। আর যখন বড় বড় সাহেবরা সারাদিন কাজ করানোর পর দিনশেষে বলে, “ যা পরে নিস।” তখন যেন সারাদিনের কাজের ক্লান্তিগুলো একসাথে এসে আছড়ে পরে সমগ্র শরীরে। হতাশায় ধীর গতিতে পথচলা সেই বাবার মনের ভাবনা, “যাই হোক, অসুবিধা নাই, বাড়ি গিয়ে একটু সেমাই খেয়ে শুয়ে থাকবো তাই ভালো।” কিন্তু বাড়ি ফিরে যখন ক্লান্তিভরা দেহে স্ত্রীকে বলে, “একটু সেমাই দাওতো।” আর ঠিক সেই সময় দুখিনী স্ত্রী যখন বলে, “ সেমাইতো নাই। বাচ্চারা খেয়ে ফেলেছে।” বাবা তখন কিছুক্ষণ মায়ের দিকে আবার কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে। তার পর নিচু গলায় বলে, “ তাইলে দুই-গ্লাস পানি দেও, তা-ই খেয়ে শুয়ে থাকি।” কিন্তু এ কথা সত্য যে, এই বাবা-মার বেদনা তার চেয়ে হাজার গুণ বিশাল তাদের ছেলে মেয়েগুলোর ইদ আনন্দ।
এমনই এক আনন্দের প্রতিচ্ছবি আমি দেখেছিলাম এই ইদে এক পল্লীবালার মুখে। তার একটি হাসিতেই জানিয়ে দিল যে, ইদে তোমাদের মতো বড় বড় দামী কাপড় পরা ও পকেটে হাজার হাজার টাকা নিয়ে ঘুরতে আসা ধনীর দুলালদের চাইতে অনেক বেশী আনন্দে ভরা আমার ইদ। যদিও আমি বাবার সাথে যখন বাজারে গিয়েছিলাম আমি আমার বাবাকে তোমাদের মতো দামি দামি কাপড়গুলোই দেখিয়েছিলাম। বাবাকে বলেছিলাম, “বাবা ঐ লালটা, বাবা ঐ লাল জামাটা, বাবা আমি লাল জামাটা নিব।” কিন্তু বাবা উপরে তাকিয়ে জামাটা দেখেওনি। বাবা যেটা পছন্দ করেছে সেটাই দিল। সাথে দিল বুকভরা ভালোবাসা।
ঠিক তাই। ইদের দিন বিকেলে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঘুরতে গেলাম তিতাস থানার একটি ব্রিজ দেখতে। যদিও একটি অজপাড়া গ্রাম কিন্তু ব্রীজটি সুন্দর হওয়ায় এখন ট্যুরিস্ট প্লেস হয়েগেছে। সেখানেই আমার এই পল্লীবালার দর্শন হলো। হাজারো মানুষের ভীড়। কত বড় বড় লোকের সন্তান-সন্ততিরা পরিবারসহ এখানে এসেছে। কোনো কোনো মেয়েরা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার তাদেরকে বাতাসও করছে। কেউ কেউ আবার টিস্যু দিয়ে মুখ মুছছে বারবার। দামি দামি খাবারের দোকানগুলোতে দামি দামি লোকের সরাগম। কেউ কেউ আবার ব্রীজের ধারে বসে কপোত-কপোতির ভূমিকা পালন করছে। ছেলেদেরও পোশাক পরিচ্ছদে নানান ভাবের পরিচয়। কারো কারো আবার এমন বেশ যে, পায়ে কেডস আছে কিন্তু মোজা নাই আবার প্যান্ট ভাজ করা, শার্টের কলার তোলা। কারো কারো আবার মাথায় রুমাল বাঁধা। এক কথায় এক বর্ণিলচিত্র। এসকল বিচিত্র চিত্রগুলো দর্শনেই কাটছিল আমার তিতাস দর্শন।
ফেরার পথে গাড়িতে উঠলাম। কিন্তু একটা হাসি হাঠাৎ থামিয়ে দিল আমায়। একটা ৮-৯ বছরের মেয়ে, পড়নে একেবারে কমদামি টেট্রনের কাপড়। লাল ফুলের ছাপ, হাতে প্লাস্টিকের রঙ্গিন চুড়ি, চুলে লাল সবুজের ফিতে বাঁধা, পায়ে সেন্ডেল, ঠোঁটে একেবারে কমদামি লিপস্টিক। গায়ের রঙটা- যদিও আমার কাছে তার গায়ের রঙটি মনে হচ্ছিল যেন বৈশাখের বিকেলে ঈশাণ কোনো জমাট বাধা শান্তির বৃষ্টি বহনের মেঘমালার কালো কাপড় তবে আমাদের জাগতিক ভাষায় তাকে কুচকুচে কালো বলে। দেখতে রুগ্ন ও চিকন সেই মেয়েটির হাতে একটি দশটাকার নোট। এতে বুঝার অপেক্ষা রাখেনা সে কেমন ঘরের মেয়ে।
পল্লীবালা তার অন্য সখিদের হাত ধরে হেসে হেসে রাস্তা পার হচ্ছিল। তার হাসিতে যে কতোটা তৃপ্তি ভরা শান্তি ছিলো, সেটা আমার মতো করে কেউ দেখে থাকলে ঠিকই টের পাবে। জানিনা ঘরে খাবার আছে কিনা। জানিনা তার বাবা মা কি করে তার সংসার চালায়, জানিনা এই সাজ সামগ্রী বাবা দিল নাকি কারো কাছ থেকে যাকাতের অংশ হিসেবে পওয়া। শুধু এইটুকু বলতে পারি, ইদ মানে যে আনন্দ তা তার ভুবন ভুলানো হাসিই পেরেছে শতভাগ প্রমাণ করতে। যে হাসির সামনে হাজার হাজার, দামি দামি কসমেটিক্স ও জামা-কাপড় বিলীন হয়ে যেতে পারে নিমিষেই।
জন্মের পর থেকে যারা অভাব দেখেনি, যারা না চাইতেই সব হাজির। যাদের মন খারাপ দেখলেই বাবা-মারা হাজার হাজার টাকা খরচ করে। তার কি এই পল্লীবালার হাসিটির অর্থ বুঝবে? অথচ অল্পতে সন্তুষ্ট এই পল্লীবালার হাসিটির অর্থ যদি আমরা একবার মন থেকে এভাবে ভেবে দেখতাম তাহলে আমার বিশ্বাস ইদের হাসিতে কোনো ব্যবধান থাকতো না।
ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে রাত পোহাবার অপেক্ষায় থাকতো না কোনো ঘর। সমাজের প্রতিটা হাসির মূল্য হতো সমান। এদেশের এমন অসখ্য পরিবার আছে যাদের প্রতিটি পরিবারই এমন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।ইদের মতো দিনেও কারো মুখে জুটছেনা দু’মুঠো খাবার। বিত্তশালীদের বিলাসিতার আকাশচুম্বি আকাঙ্খার চাপায় পরে এমন পরিবার গুলো আমাদের সামনে থেকেও চোখের আড়াল হয়ে থাকে।
আসুন অন্তত দেশের এই দুর্দিনে সে সকল মানুষের পাশে দাঁড়াই। নিজের খাবারের ভাগ অন্যকে দিতে শিখি। আমিতো এই অবস্থাতেও ভালোমন্দ খাচ্ছি। আমার পাশের ঘরটির লোকগুলো খেয়েছেতো? যে শিশুটি ইদের দিনে তৃষ্ণার্ত কাকের মতো বাজারের সুন্দর সুন্দর কাপড়গুলোর দিকে চোখ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো, তাকে তার পছন্দের জামাটা দিয়ে তার হাসিটা ফিরিয়ে দেই। আসলে মানুষের জীবনের স্লোগান তো হওয়া উচিৎ ছিল কবিতার লাইনের মতো,
“সবার সুখে হাসবো আমি কাঁদবো সবার দুখে,
নিজের খাবার বিলিয়ে দিব অনাহারির মুখে।”
