গল্প- স্মৃতির পুনরাবৃত্তি

গল্প “স্মৃতির পুনরাবৃত্তি ”
-মোঃ কামরুজ্জামান বাবু
পরিচ্ছন্ন সকাল ; নৈঃশব্দের আদলে ঘেরা এই বাড়ি, যার নাম নিসর্গ। পশ্চিম মুখী বারান্দায় বসে আছেন রাহেলা বেগম। সামনের কাঁঠাল গাছে পাখির কলকাকলি, প্রকৃতির নিরব স্বতস্ফূর্ত আয়োজন, অথচ এতসব আয়োজন যেন ম্লান হয়ে যায় রাহেলা বেগমের গম্ভীর মুখের কাছে। পার্থিব যেসব উপাদান তার অভ্যন্তরে নীরবে, অতি সন্তর্পনে ছাপ ফেলে – সেগুলোয় রাহেলা বেগমের এই গাম্ভীর্যতা প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায় চোখের ক্রমাগত জলধারায়, যেন সবুজের দুঃখ স্নান করে আর্তনাদ করে। আজও তিনি কাঁদবেন। বাড়ির কাউকে তারে চোখের জল দেখতে হবে না বলে নিজেকে নিয়ে এই নিসর্গে তার অবাধ লুকোচুরি। মুসলেহউদ্দিন রাহেলা বেগমের দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই। রাহেলা বেগম বছরের এমন একটি দিন এ ভাইটার জন্য অপেক্ষা করেন। অন্যদিনের কথা বাদ থাক, আজকের এই দিনে তিনি না এলে ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় মনের সকল আবেদন।
আজ শিপুর জন্মদিন। এ বাড়ির কারো এই দিনটা মনে না থাকলেও তার আছে। মোসলেহ উদ্দিনের আছে। মুসলেহ উদ্দিন সাহেব আজ আসবেন। রাহেলা ঘর অন্ধকার করে কেকের গায়ে মোম জ্বালিয়ে মুসলেহ সাহেবের বিপরীতে বসে সেই গল্পটা শুনবেন, যে গল্প স্মৃতির গাঁথুনিতে রাহেলা বেগমের চৌত্রিশ বছর ধরে শুনছেন। যতবার শুনে, ততবারই চোখ মুছে। এ যে তার প্রিয় সন্তানের গল্প। তার শহীদ সন্তান শিপুর গল্প। রাহেলা বেগমের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটায় মুসলেহ উদ্দিন সাহেব। তিনি কখনো বিরক্ত হননি এই গল্প শোনাতে। আজও বরাবরের মতো রাহেলা বেগমের বিপরীতে বসে সেই চিরচেনা ভংগিতে গল্প শুরু করেছেন। মাঝে আর ঘরে মোমের আলো দুজনেরই চোখে জলে ঝলক খেলে যায়। “…… শিপু তখন সবে দুপুরের খাবার সেরে আমার কোলে মাথা রেখে গুনগুন করে গান গাইছিল।
আমি বুকে চাপড় মেরে বলেছিলাম, কিরে ব্যাটা! দেশটাকে মুক্ত করতে পারবি তো? ” জানিস রাহেলা! কি উদ্ধত কন্ঠ ছিল তার, এই কথা বলতে বলতে যেন তার গায়ের প্রতি লোমকূপে আগ্নেয়গিরির উদগীরণ দেখলাম। ভরাট গলায় আমাকে বলেছিল, ” মামা আমার মা বেরুবার সময় বলেছিল যেন দেশের আগাছাগুলো পরিষ্কার না করে ফিরে না যাই। মামা, বুকের ভেতরটা খা খা করে ওঠে যখন সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ শুনি, সম্ভ্রম হারা কোন বোনের ক্রন্দনধ্বনি, আত্মা গলে যায় পঁচা লাশের গন্ধে। মামা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি যদি মরে যাই, আমাকে তোয়ারপারবেনা, মাকে সান্ত্বনা দিও। আজ রাতের অপারেশনটা আমার একটা স্বপ্ন। কি বলো মামা? ফিরতে পারব তো? ” এই আমার শেষ কথা শিপুর সাথে। সে যখন ফিরে এলো, তখন সে প্রাণহীন একটা লাশ। জানিস রাহেলা, তখন আমার চোখে পানি আসে নি, আমি কোথাও বলতে পারিনি। দুজনের চোখে জল, ঠোট কেঁপে কেঁপে উঠছে, আর সেই কাঁপুনিতে বুঝিবা পৃথিবী কাঁপছে। রাহেলা আশ্চর্য হয় না। চোখের পলক ফেলছে না।
দুপুর গড়িয়ে পড়ছে, চোখ বড় বড় করে তাকায় রাহেলার দিকে। এমন তো করেনি কখনো রাহেলা! কপালে হাত রাখতেই বিকট শব্দে চিৎকার করে ওঠে রাহেলা। খুব দ্রুত নিজেকে সংবরণ করে নেয়। অবশ্য সংবরণ করতে বাধ্য হলো। আর শব্দ করবেনা রাহেলা। উৎসুক চোখে প্রতিটা দিন, প্রতিটা ছবিতে দেখবেন আড়াইশো মাইল পাড়ি দিয়ে প্রতিটা বছরের এই দিনে রাহেলার কাছে আসতে হবে না, এই পুনরাবৃত্তি করতে আজ থেকে আর ভালো লাগবে না – বিড়বিড় করে বলছেন। নিজে ভালো থাকিস অপেক্ষা করিস আমি আসবো তোকে নিয়ে যুদ্ধের কথা বলব মন নিয়ে যায় সূর্যের করে উদ্দিনের দুচোখের জল মোম নিভে যায়। সূর্যের কড়া রোদে চিকচিক করে মোসলেহ উদ্দিনের দুচোখের অবারিত জল বুঝিবা ক্রন্দন মিলিয়ে যায় ওই দূর বহুদূর কোন এক অজানা ঠিকানায়।
