চীনে মুসলিম শিশুদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ চীনের পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিম শিশুদের তাদের পরিবার থেকে আলাদা করা হচ্ছে, যেন তারা নিজ ধর্ম এবং ভাষা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে পারে। সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির করা নতুন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বিভিন্ন সরকারি নথি এবং বিদেশে বসবাস করা চীনের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে শিনজিয়াং এ মুসলিম শিশুদের সঙ্গে কি ঘটছে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক জন সুডওর্থ। এক্ষেত্রে তুরস্কে পালিয়ে যাওয়া উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। তাদের অনেকেই চীনে নিজ সন্তানকে হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তাকে।
শিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুরদের উপর চীন সরকার যে নির্যাতন করছে তার সরাসরি প্রমাণ সংগ্রহ করা বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য একদম অসম্ভব একটি ব্যাপার। কারণ চীন সরকার ওই অঞ্চলটি কড়া নজরদারি এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছে। ফলে ভিনদেশি সাংবাদিকদের ২৪ ঘণ্টাই অনুসরণ করা হয়। তবে তুরস্কে পালিয়ে যাওয়া উইঘুরদের কাছ থেকে এই ব্যাপারে সহজেই তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
বিবিসির সাংবাদিকের কাছে নিজেদের কষ্টের কাহিনী তুলে ধরার জন্য ইস্তাম্বুলের বড় একটি হলঘরে বিপুল সংখ্যক উইঘুর লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসময় তাদের অনেকেরই হাতে শিশুদের ছবি ছিল। নিজ ভূমি শিনজিয়াং এ এসব শিশুকে ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছেন তারা। কারণ চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে এদের অন্যত্র নিয়ে গেছে।
একজন মা তার তরুণী তিন কন্যার ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘আমি জানি না কে তাদের দেখাশোনা করছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোন উপায় নেই।’
আরেক মা তার তিন পুত্র এবং এক কন্যার ছবি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখের পানি মুছে হতভাগ্য এই মা বলেন, ‘আমি শুনেছি তাদের এতিমখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
এরকম ৬০ টি আলাদা সাক্ষাৎকারে বাবা-মা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন শিশুদের নিয়ে তাদের উদ্বেগ, কষ্ট ও বেদনার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন। হতভাগ্য এসব মানুষ শিনজিয়াং এ তাদের শতাধিক শিশু কীভাবে হারিয়ে গেছে তার বিস্তারিত উল্লেখ করেন।

উইঘুর এসব মুসলমানদের সঙ্গে ভাষা এবং ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে তুরস্কের মিল রয়েছে। মূলত এদের জাতিগতভাবে তুর্কিও বলা যেতে পারে। ফলে চীনা সরকারের নির্যাতনের কবল থেকে বাঁচার জন্য উইঘুরদের অনেকেই তুরস্কে পালিয়ে আসেন। কেউবা ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য, আবার অনেকেই লেখাপড়া করার জন্যও তুরস্কে যান।
শিশুদের বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি হাজার হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানদেরও বিশাল একটি ক্যাম্পে আটকে রেখেছে চীনা সরকার। কট্টরপন্থার হাত থেকে রক্ষার নামে উইঘুর সম্প্রদায়ের এসব মানুষের মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরকারি দপ্তরের রেকর্ড থেকে দেখা গেছে, কেবলমাত্র একটি শহরে ৪০০ এর বেশি শিশু হয় তাদের বাবা অথবা মা কিংবা কেউ কেউ বাবা-মা উভয়কেই হারিয়েছে। এসব শিশুর বাবা-মাকে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। হয় তাদের মগজ ধোলাইয়ের শিবিরে কিংবা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
শিশুদের কেন্দ্রীভূত যত্নের প্রয়োজন আছে কি না তা নির্ধারণের জন্য আনুষ্ঠানিক মূল্যায়নও করা হয়। শিংজিয়াং এর প্রাপ্তবয়স্কদের মগজ ধোলাইয়ের পাশাপাশি শিশুদের তাদের মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রচারণা চালানোরও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
শিনজিয়াং অঞ্চলটি দীর্ঘ দিন ধরেই চীন সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। কিন্তু এই কঠোর নিয়ন্ত্রণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই উইঘুরদের উপর ব্যাপক নজরদারি শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে বিগত তিন বছর ধরে চীন সরকার উইঘুর সম্প্রদায়ের অনেককেই বিশাল বিশাল সব শিবিরে আটক করে রাখছে। পাশ্চাত্যের সমালোচনার মুখে চীনা কর্তৃপক্ষ জানায়, উইঘুরদের আটকে রাখা হয়নি বরং ধর্মীয় চরমপন্থার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে রেখে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু বিভিন্ন প্রমাণ থেকে দেখা গেছে, কেবলমাত্র ধর্মীয় জীবনযাপনের জন্যই তাদের অনেককেই আটক করে রাখা হয়েছে। এদের কেউ কেউ হয়তো নিয়মিত নামাজ পড়তো, আবার কাউকে কেবলমাত্র হিজাব পড়ার কারণেই আটক করা হয়েছে। তুরস্কের মত দেশের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কারণেও কাউকে আটক করে রাখার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তুরস্ক কিংবা অন্যান্য দেশে থাকা উইঘুরদের নিজ দেশে ফেরত যাওয়া মানেই এদের নিশ্চিত আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। এরা ফোনের মাধ্যমেও শিনজিয়াং এ থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। শিনজিয়াং এ থাকা কেউ যদি বিদেশে অবস্থান করা আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাহলে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে চরম কোন বিপদ।

একজন বাবা বিবিসির সাংবাদিক জন সুডওর্থকে জানান, তিনি আশংকা করছেন তার ৮ সন্তানকে চীনা রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা তাদের শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে রাখা হয়েছে।’
জার্মান গবেষক ডক্টর অ্যাড্রিয়ান জেনজ চীনের শিনজিয়াং অঞ্চলের আটককেন্দ্রগুলোতে বিপুল সংখ্যক উইঘুর মুসলিমদের আটকে রাখার বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে আনেন। জনসম্মুখে প্রকাশিত নথির ভিত্তিতে তিনি দেখান কীভাবে ওই অঞ্চলে চীনা সরকার মুসলমানদের মগজ ধোলাই করার জন্য স্কুলের বিস্তার ঘটাচ্ছে।
বিশাল ক্যাম্পাসের এসব স্কুলে শিশুদের থাকার জন্য নতুন আবাস তৈরি করা হচ্ছে। বড়দের জন্য আটককেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি শিশুদের জন্যও রাষ্ট্রীয় শিক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে সেসব শিশুরই স্থান হচ্ছে যাদেরকে বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। কেবলমাত্র উইঘুর মুসলমানদের লক্ষ্য করেই এই মহাযজ্ঞ করছে চীনা সরকার।
২০১৭ সালে মাত্র একবছরেই শিনজিয়াং প্রদেশে সরকারী কিন্ডারগার্টেনে শিশু ভর্তির হার ৫ লাখের বেশি বেড়েছে বলে সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে। এদের মধ্যে উইঘুর এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলমান শিশুদের ভর্তির হার শতকরা ৯০ ভাগের বেশি বেড়েছে বলে জানা গেছে।
দক্ষিণ শিনজিয়াং অঞ্চলে কিন্ডারগার্টেনের উন্নতি ঘটানো এবং শিশু শিক্ষা ভবন তৈরির জন্য চীনা সরকার ১.২ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।
চীনের শিনহেই কাউন্টির ইয়ুয়ি কিন্ডারগার্টেনে ৭০০ জন শিশুর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ শিশু উইঘুর সম্প্রদায়ের।
চীনা সরকার জানায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুরা যেন সহজেই মূল জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে সেজন্য তাদের বিশেষভাবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অ্যাড্রিয়ান জেনজ জানান, এর পিছনে চীন সরকারের সুগভীর উদ্দেশ্য রয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, বোর্ডিং এসব স্কুলগুলো সংখ্যালঘুদের একটি দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক পুনর্বিন্যাসের জন্য আদর্শ প্রেক্ষাপট সরবরাহ করে। এসব স্কুলে কেবল চীনা ভাষা শিক্ষার উপর জোর দেয়া হয়। উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘু শিশুরা যেন নিজ ভাষায় কথা না বলে সে ব্যাপারে জোর দেয়া হয়। স্কুলগুলোতে চীনা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বললে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
এদিকে সরকারী বিভিন্ন নথিপত্রে দেখা গেছে, শিনজিয়াং প্রদেশের স্কুলগুলোতে শিক্ষার ক্ষেত্রে চীনা ভাষার সফল প্রয়োগ ঘটাতে পেরেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
