কিছু গল্পের হয়তো কোন শেষ হয় না। মনে হয়, এই বুঝি গল্পটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ হতে হতেও আর শেষ হয় না। উল্টো সে গল্পের সাথে অন্য আরেকটা গল্প জুড়ে বসে এবং শুরু হয় নতুন আরেকটা অধ্যায়। এভাবেই হয়তো এক একটি সিরিয়ালও তৈরি হয়ে যায়। আমরা নানা সিরিয়াল কে ফালতু মনে করি। কিন্তু সিরিয়াল গুলো কিন্তু কোন কল্প কাহিনী নয়। মানুষের জীবন থেকেই প্রেরনা নিয়ে গড়ে উঠে।
এই জীবনে বহু মানুষের সাথেই পরিচয় হয়েছে। তাদের জীবন সম্পর্কে শুনেছি, জেনেছি, বহু জীবন দেখেছি। অবাক করা বিষয় হল, এমন প্রতিটি জীবন কাহিনী এক একটি নাটক বা সিরিয়াল বা সিনেমা তৈরী করার যোগ্য।
কখনও কখনও অবাক লাগে। এমন কিছু মানুষের জীবন আমার খুব সহজ সরল ও পারফেক্ট মনে হয়। দূর থেকে মনে হয়, বেশ তো তারা আছে। সব দিক থেকেই তারা ভরপুর। কোন দিক থেকেই কমতি নেই। পরিবার, বন্ধু, ভালবাসা, বাহ্যিক সৌন্দর্য, আর্থিক স্বচ্ছলতা, চাকরী, শিক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এদের জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখলে বা জানলে বোঝা যায়, এরাও পারফেক্ট হয়েও পারফেক্ট নয়। এদের জীবনেও রয়েছে কোন না কোন কালো অধ্যায় যদিও সেই অধ্যায় কখনও না কখনও শেষ হয়েছে, নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে নতুন সূর্য নিয়ে। কিন্তু সেই কালো অধ্যায়ের ছায়া কি জীবন থেকে পুরোপুরি চলে যায়? জানি না। হয়তো যায়। আবার হয়তো নতুন কোন ছায়া হয়ে বেঁচে থাকে।
এক প্রতিবশী ছোটবোনকে দেখেছিলাম, রূপ, সৌন্দর্যে, পারিবারিক ভালবাসায়, শিক্ষায়, বন্ধুদের ভালবাসায়, সবার পছন্দ করার মত মেয়ে হিসেবে পারফেক্ট। সেই মেয়ের পছন্দ করে বিয়ে করা হয় তার মতই পারফেক্ট একজন ছেলেকে। ভাগ্যের কি পরিহাস। কয়েক বছরও টিকলো না। নিজের জীবন যুদ্ধে কঠিন চেষ্টায় পড়ালেখা শেষ করে বিসিএসের প্রস্তুতি, তারপর চাকরি, এরপর নিজের ক্যারিয়ার ও পড়া একসাথে চালিয়ে আবারও ভালবাসা ফিরে পায় নতুন কোন পারফেক্ট ভালবাসার মানুষের মাঝে। অভাবে থেকেও ভালবাসা নিয়ে কতটা ভাল আছে তা প্রকাশ পায় তাদের ফেসবুক পোস্টে।
এমনই এক বান্ধবীকে দেখেছিলাম। মা-বাবা ছাড়া এতিম একা একটি মেয়ে যাকে দেখা শোনা করার মত একজন অভিভাবকও ছিল না। আমার মা ই তার ঢাকা শহরে একজন অভিভাবকের মত ছিল। নিজে টিউশনি করে নিজের পড়ালেখা চালাতো ও টাকা জমাতো নিজের একটু ভাল জীবনের আশায়। সেই মেয়ে শুনলাম হঠাৎই একদিন কাউকে না বলে বোকার মত বিয়ে করে বসে। ছেলেটা কিছুদিন মেয়েটার টাকায় ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। মেয়েটার সব জমা টাকা শেষ হবার পর একদিন পালিয়ে যায়। পরে খবর পাওয়া গেল সেই ছেলে কিছুদিন পর সিঙ্গাপুর চলে গেছে।
আমার সেই বান্ধবী অনেক কষ্ট পায়, কান্নাকাটি করে, কেস করে, অনেক ভাবে চেষ্টা করে। টাকার অভাবে কিছুই করতে পারে নি। দেশে থাকলে তবু ধরা যেতো। বিদেশে পালিয়ে যাওয়া কাউকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। মেয়েটা যখন নিজের ভাগ্য নিয়ে লড়ছে তখনই ফোনে কথা বলতে বলতে প্রেম হয় একজন সুদর্শন ছেলের সাথে। ছেলেটি সব জেনে শুনেই তাকে বিয়ে করে। এাবার মেয়েটির ভাগ্য খুলে গেল। ছেলেটা এতই ভালবাসতো ওকে যে সেই বান্ধবী নিজেই বলতো যে তার স্বামী ভুল করেও অন্য কারো দিকে তাকাবে না।
আমি হেসে বলতাম, "পুরুষের কোন ভরসা নাই।" যা বলেছিলাম তাই হল। ৫ বছর ভাল ভাবে সংসার করার পর, স্বামীকে নিজ টাকায় পড়ালেখা করিয়ে, চাকরীতে ঢুকিয়ে, আবারও কষ্ট পেলো। ছেলেটার চাকরী নাই বহু মাস। মেয়েটা সারাদিন টিউশনি করে সংসার চালায়। বেকার সময়ে প্রেম গড়ে উঠে একটা সুন্দর মেয়ের সাথে। এই নিয়ে রোজ ঝগড়া, স্বামী পিটাতো তাকে বেল্ট দিয়ে। সে কাঁদতে কাঁদতে আমার মা কে কালো হয়ে যাওয়া শরীরে মারের দাগ দেখাতো।
এভাবেই একটা চাকরী জুটে গেল যেখান থেকে দুই নাম্বার পথে লাখ লাখ কামাই করা যায়। মেয়েটা সারাজীবন অভাবে থাকতে থাকতে হঠাৎ টাকার মুখ দেখে যেন পাগল হয়ে উঠলো। এখন স্বামী, দুই বাচ্চা নিয়ে বেশ আছে। তবে জানি না পারফেক্ট আছে কি না! হয়তো তার জীবনও আরও সিরিয়াল বানিয়ে চলেছে আগের মত।
নিজের জীবনটাও আমার এমনই সিরিয়াল মনে হয়। একটার পর একটা অধ্যায় শেষ হয়, আবার শুরু হয়। তবে অদ্ভুত হলেও সত্য যে, আমার জীবনে এমন একটা বিষয় বা একটা দিক বা একটা অধ্যায়ও পারফেক্ট ছিল না, এখনও নাই। ভবিষ্যতে হবে এমন আশা করা বোকামী। কারন আমার প্রতিটা অধ্যায় এই আশাতেই শেষ হতো, "সামনে সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার বুঝি সব পারফেক্ট হবে।" কিন্তু ভাগ্য হেসে হেসে আমার জীবনটা তামাশাই বানিয়ে দিয়ে বলে, "তোর জন্ম পারফেক্ট হতে হয় নি।"
আমার সিরিয়ালও হয়তো এভাবেই চলবে অন্য সবার সিরিয়ালের মত। শেষটা হয়তো শেষ হয়েও আর শেষ হবে না।
সম্পাদক: শামীম আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক: এস এম মিজানুর রহমান মামুন, প্রকাশক: রাজন আকন্দ
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দেশেরবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম