4:43 PM, 17 April, 2024

দুই যুগে নাই হয়ে গেছে ১২ শতাধিক সিনেমা হল!

পদ্মা নদীর তীরের শহর রাজশাহী আমের জন্য বিখ্যাত হলেও সিনেমা জগতে এর অন্য আরেকটি পরিচয় আছে। বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটকের বাড়িও রাজশাহী। সিনেমা দিয়ে যে মানুষটি চিন্তার জগতে নাড়া দিয়ে মানুষের মুক্তির জন্য এক সাংস্কৃতিক লড়াই গড়ে তুলতে চেয়েছেন সেই ঋত্বিকের রাজশাহী শহরে নেই কোনো সিনেমা হল! গত বছরই বন্ধ হয়ে গেছে ‍ধুকে ধুকে টিকে থাকা এই শহরের শেষ সিনেমা হলটিও।

কীত্তর্ণখোলা নদীর তীরের শহর বরিশাল দেশের অন্যতম একটি শিক্ষা সাংস্কৃতিক চর্চার শহর হিসেবে পরিচিত। ৫৮ বর্গ কিলোমিটারে ছোট শহরটিতে এক সময় সিনেমা হল ছিলো ৪টি। ছুটির দিনগুলোতে সিনেমা হলের সামনে দীর্ঘ সাড়ি থাকতো সিনেমা প্রেমী দর্শকদের। এখন চিত্র ঠিক ভিন্ন। হল  আছে মাত্র একটি। এমন চিত্র শুধু রাজশাহী কিংবা বরিশালের না। এই চিত্র সারাদেশেই বিদ্যমান। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমাহলগুলি। গত দুই যুগের ব্যবধানে নাই হয়ে গেছে  ১২শোর উপরে সিনেমা হল। যে পরিমাণ সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে তার সিকি ভাগও তৈরি হয়নি।

এই সিনেমা হলগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে সিনেমা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে নানা মত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ক্রমশই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো।

হল মালিক সমিতির তথ্যমতে, নব্বই দশকে বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিলো ১ হাজার ৪৩৫ টি। গত দুই যুগের ব্যবধানে হলের সংখ্যা ১৭০টি। বন্ধ হয়ে গেছে ১২শ ৬৫টি সিনেমা হল। চালু থাকা ১৭০ টির ভেতর নিয়মিত চালু আছে ১১০ টি সিনেমা হলো। বাকি ৬০ টি সিনেমা হলে নিয়মিত সিনেমা প্রর্দশিত হয় না।

যশোরে ২১ টি সিনেমা হল থেকে কমতে কমতে এখন মাত্র ২টি চালু আছে। খুলনায় সিনেমা হল ছিল ১১টি। এখন আছে তিনটি। রাজশাহী জেলায় সিনেমা হল ছিল ৫৫টি সেখান থেকে কমে চালু আছে মাত্র চারটি সিনেমা হল। আর শহরে কোন সিনেমা হল নেই। এছাড়া ঢাকার মধ্যে মুন, স্টার, আরমানিটোলার শাবিস্তান, এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা, বাসাবোর অতিথি, আগমন, ইসলামপুরের লায়ন, চকবাজারের তাজমহল, পোস্তগোলার মেঘনা, যমুনা, ডায়না, নারায়ণগঞ্জের মিনতি, কাওরান বাজারের পূর্ণিমার মতো হলগুলোও হারিয়ে গেছে।

সিনেমাকে বাঁচাতে হলে প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাতে হবে বলে মনে করছেন পরিচালক সমিতির মুশফিকুর রহমান গুলজার। এই নির্মাতা বাংলা’কে বলেন, ‘আসলে সিনেমা চালিয়ে এখন হল মালিকরা লাভবান হতে পারছেন না। তাই হল ভেঙ্গে মালিকরা মার্কেট বানাচ্ছেন বা অন্য ব্যবসা করছেন। হল না থাকলে সিনেমা কীভাবে দেখবে মানুষ? তাই যেকোনো ভাবে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে হবে। এভাবে দিন দিন হল কমতে থাকলে ভবিষ্যতে বড় সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সিনেমার হল উন্নয়নে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে আশাকরি আগামী দুই বছরের মধ্যে সমস্যা কেটে যাবে।’

প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ও প্রযোজক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ মনে করেন সিনেমাগুলো ব্যবসা করতে পারছে না  বলেই সিনেমা হল উঠে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘দু-একটা ছবি বছরে ব্যবসা করছে। বাকিগুলো দর্শক নিচ্ছে না। ভালো ছবি নির্মাণ হচ্ছে না । তাই বাধ্য হয়েই হল বন্ধ করছে অনেকে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সিনেমা এখন লাইফ সাপোর্টে আছে। কয়েকটি সিনেপ্লেক্স বানানো হয়েছে। শুধু সিনেপ্লেক্স বানালে হবে না। সবার তো সিনপ্লেক্সে সিনেমা দেখার সামর্থ্য নেই। লোকাল দর্শকরা তো সেখানে সিনেমা দেখতে পারবেন না। তাই যেই হলগুলো আছে সেগুলো ঠিক করে আধুনিক করতে হবে। আর যদি দিন দিন হল হারাতে থাকে বিশাল সংকটে পড়তে হবে, এটা নিশ্চিত।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগঠক বেলায়েত হোসেন মামুন বলেন, ‘দর্শকের জীবন মানের পরিবর্তনের সাথে সাথে রুচিবোধেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে যে মানের সিনেমা হওয়া উচিত, সেটা খুবই কম হচ্ছে। দর্শক তার মনের মতো সিনেমা পাচ্ছেন না। তাই তারা হলে যেতে ইচ্ছুক হচ্ছে না। দর্শক যেহেতু যাচ্ছে না তাই হলগুলো  টিকে থাকতে পারছে না। এছাড়া চারদিকে নানা প্রযুক্তি ছড়াছড়ি। মানুষ ঘরে বসেই এখন সিনেমা দেখতে পাচ্ছে। যাই হোক, হল সংকট বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। অনেক দিন ধরেই এই সমস্যা চলছে। আমার কাছে মনে হয়, নতুন কিছু ভাবতে হবে এই সংকট উত্তরণের জন্য।’