আর করবোনা ধান চাষ দেখবো তোরা কি খাস!

“আর করবোনা ধান চাষ দেখবো তোরা কি খাস!” বাংলাদেশের কৃষক/কৃষক পরিবারের মানববন্ধনে বর্তমান প্রতিবাদের ভাষা এটা।আমাদের বাংলাদেশ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামল সবুজের রুপ বৈচিত্রের দেশ।গ্রামের সুজলা সুফলা সবুজের সমারোহই বাংলার প্রাণ, কোন শহরের ইট পাথরের দেয়াল নয়।আর এর কারিগর হচ্ছে আমাদের গ্রাম বাংলার চিরচেনা কৃষক।কৃষক আছে বলেই শস্য শ্যামল এ ভুমি,কৃষক আছে বলেই চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ।কৃষক না থাকলে দেশটা হয়তো সাহারা মরুভূমি নয়তো আফ্রিকার জঙ্গল হয়ে থাকতো। কৃষক না থাকলে আমাদের অনাহারে জীবন কাটাতে হতো। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদার শুধু পানি বাদে সকল পন্যের অবদান হচ্ছে কৃষক।যদি কারও বিশ্বাস না হয় গভীর মনযোগ দিয়ে চিন্তা করে দেখতে পারেন।আমরা বাচার জন্য খাই কিন্তু এই খাদ্য উপাদনটা কৃষকের হাত দিয়েই আসে।যদিও সবকিছুর মালিক মহান রাব্বুল আল-আমীন কিন্তু তাই বলে তিনি নিজ হাতে কিছুই দেননা।এর জন্য উনার পক্ষ হতে কারও মারফতে বা উছিলা দিয়ে দেন।আমরা বাচার জন্য যা খাই সেই উপাদানগুলোর উছিলা হচ্ছে আমাদের কৃষক।কৃষক বাচলে বাঁচবে দেশ, কৃষক আছে বলেই আমরাও খেয়ে খেয়েপড়ে বেচে আছি।
একজন দিনমজুর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যাক্তি পর্যন্ত সকলেই কোন না কোন কৃষকের সন্তান অথবা কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা কেউ।কারও বাবা/দাদা/পরদাদা/দাদারও দাদা কেউ না কেউ কৃষক ছিল অথবা আছেন।অথছো এই ত্যাগী কৃষকই আজ আমাদের কাছে অবহেলিত অধিকার বঞ্চিত। তারা পাচ্ছেনা তার উৎপাদিত পন্যের সঠিক মূল্য। তারা কারও কাছে সম্মান চায়না, দুমুঠো ভাত চায়না, তারা শুধু তাদের উৎপাদিত পন্যের ন্যায্যমূল্য চায়।তাদের হাড় খাটুনি পরিশ্রমের দাম চায়।
চৈত্রের খড়াতাপে, বৈশাখের ঝড়ে, আষাঢ়ের বৃষ্টিতে, মাঘের কনকনে শীতে হাজার কষ্ট করে একজন কৃষক তার জমিতে ফসল ফলায়।জমিতে ফসল ফলিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে, স্ত্রী পরিজন নিয়ে সুখের দিন গুনে, ছেলে মেয়েকে স্কুল/কলেজ/ভার্সিটিতে পড়ানোর হিসেব মেলায়।কিন্তু সময় পেরিয়ে নির্ধারিত দিনে সেই ফসল তুলে যদি তার সঠিক মূল্য না পায় তখন তার ভাগ্যে হাহাকার ছাড়া আর কিছুই থাকেনা।তখন তার স্বপ্ন তো দূরে থাক পরিশ্রমের গন্ধই শুকায়না।
বর্তমান বাংলাদেশে একজন কৃষকের একমন (৪০ কেজি) ধান (শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত) ঘরে তুলতে সর্বমোট খরচ হয় আনুমানিক ৮০০-৯০০ টাকা। অথছো এই একমন ধানের বর্তমান বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫০০-৬০০ টাকা, যা দিয়ে বাজারে এক কেজি গরুর গোস্ত পাওয়া যায়।লাভ তো দুরের কথা শুধু খরচের টাকা থেকেই ৩০০-৪০০ টাকা লস আর রোদ বৃষ্টিতে ভিজে পুড়ে হার খাটুনি পরিশ্রম সবটুকুই লস।এখন আমি যদি কেজিপ্রতি ধানের হিসেব করি সেখানে মূল্য দাঁড়ায় ১২.৫০ টাকা থেকে ১৫ টাকা।আর যদি চালের হিসেব করি সেখানে কেজিপ্রতি চাল দাঁড়ায় ১৬.৬৬ টাকা থেকে ২৪ টাকা সর্বোচ্চ (এটা শুধুই আমার এলাকার হিসাব,অঞ্চলভেদে দাম আরও কম বেশি হতে পারে)।অথছো বর্তমান বাজার মূল্যে চাল কিনতে গেলে কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা থেকে উপরে।তারমানে অর্ধেকেরও বেশি ব্যবধান। এর প্রকৃত সুবিধা এবং লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা, মানে কৃষক ঠকিয়ে এবং কৃষকের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে যারা ধান কিনে নিয়ে ব্যবসা করছে।সরকার নির্ধারিত ১০৪০ টাকা করে থাকলেও এটা মানছেননা মধ্যস্বত্বভোগী মিল মালিকদের কেউ-ই।মনে হচ্ছে তারা একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে কৃষকদেরকে জিম্মি করে রেখেছে।সরকার নির্ধারিত মূল্য থাকলেও ঠকানো হচ্ছে সাধারণ কৃষকদের।আর তাই সারা বাংলার কৃষক এত পরিশ্রমের ফসল তাদের ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে রাগে দুঃখে মনের কষ্টে প্রতিবাদে পাকা ধানে আগুন দেয়া শুরু করেছে।ধান খেতে রেখেই গরু দিয়ে মই দিয়ে পুতে ফেলা হচ্ছে।রাস্তার উপর ধানের বস্তা ফেলে মানববন্ধনে জেগে উঠেছে সারা বাংলার কৃষক/কৃষক পরিবার।তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে দেশের ছাত্র সমাজ ও আমজনতা। টাকার অভাবে অনেকেই ধান কাটতে পারছেনা বলে এবং ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেনা বলে সারা বাংলায় আজ ছাত্র শিক্ষক সাংবাদিক বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারী ধান কেটে দিচ্ছে।
কৃষকদের এই প্রতিবাদ আসলে আমাদের জন্য চরম লজ্জা।এখন আবার তাদের এই প্রতিবাদ নিয়েও অনেকেই রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে।অনেকের অনেক মন্তব্য, কেউ বলে উস্কানি, কেউ বলে কোন একটা গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র।আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ভাই আপনি শুধু এখানে উস্কানি আর ষড়যন্ত্রটাই দেখলেন? একটিবার কি সেই কৃষকের বুকের ভিতরের আর্তনাদটা দেখেছেন? কৃষক বাবার সাথে জমিতে একবেলা কাজ করে তার সেই কষ্টটা কি অনুভব করেছেন? সবকিছুতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ না খোজাই ভাল।
কেন আজ ধানের বাজারে ধ্বস? প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ধান উৎপাদনের ফলেও কেন পাশের রাষ্ট্র ভারত থেকে হাজার হাজার টন চাল আমদানি করা হচ্ছে? এই চাল আমদানির প্রভাব কি আমার দেশের ধানের বাজারে পড়েনি?
একজন তো এক মিটিংয়ে বলেই ফেললেন যে ভারত থেকে আমদানি করা চালটা ঢাকা শহরের বড় বড় পাচ তারকা হোটেলের জন্য।ঐ হোটেলগুলোয় কেউ মোটা চালের ভাত খেতে পারেনা তাই ভারত থেকে চিকন চাল আমদানি করা হচ্ছে। মুষ্টিমেয় কয়জন লোকের জন্য হাজার হাজার টন চাল আমদানি কেন, সরি হাজার নয় লাখ। লাখ লাখ টন চাল কেন আমদানি করা হচ্ছে? আমাদের দেশের কৃষক মেরে কাকে খুশি করার জন্য এসব? চুক্তি ছাড়া তো এক দেশের চাল আরেক দেশে আমদানি হতে পারেনা।আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ধান উৎপাদন হয় তবু কেন এই আমদানি চুক্তি?
একজন বলেছেন বাহির থেকে যেন চাল আমদানি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।খেয়াল রাখতে হবে কেন? চুক্তি বাতিল করে দিলেই তো হলো।
কেন আজ আমাদের কৃষকের মাঝে হাহাকার বুকফাটা আর্তনাদ? কেন আজ তাদের মুখে লাথি? আমি ছোটবেলা থেকেই কোন মিল মালিক/মধ্যস্বত্বভোগীকে ব্যাবসায় লস খেয়ে মরতে শুনিনি বা বুক চাপড়ে কাদতেও দেখিনি।কিন্তু একজন কৃষককে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাদতে দেখেছি, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে শুনেছি।
আমাদের দেশের কৃষক তো রাজনীতি করেনা তারা রাজনীতি বুঝেনা বুঝতে চায়ওনা তবু কেন তাদের সাথে এমন আচরণ? ছোটবেলায় কারও মুখে শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,আমার কৃষক রাজনীতি করেনা।
সত্যিই তো তারা রাজনীতি করেনা।যদি রাজনীতি করতো তবে আজ আমাদের চালের পরিবর্তে খুদ খাওয়া লাগতো, পাটশাকের পরিবর্তে কাঠাল পাতা খেতে হতো।তবু কেন কৃষকদের সাথে এই প্রহসন, এই অবিচার?
মিল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ে মিটিং করে বলবেন যে প্রকৃত কৃষকের কাছে সরকারের যাওয়া সম্ভব নয় তাই এদের দিয়েই কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে।এটা করা মানেই তো হচ্ছে শিয়ালকে ছাগল পাহাড়ায় নিয়োজিত করা।সরকার ইচ্ছা করলে সবই পারে, দেশের প্রতিটা ইউনিয়নে দিন নির্ধারণ করে সেই দিনে ঐ ইউনিয়ন এলাকার প্রতিটা কৃষকের কাছ থেকে তাদের ধানের ন্যায্যমূল্য পরিশোধ করে সরকার মজুদ করতে পারে।
শহরের ২০ তলা বিল্ডিংয়ে এসির মধ্যে থেকে কৃষক বাচলে বাচবে দেশ বলেই ক্ষান্ত হলে চলবেনা তাদের পাশে দাড়াতে হবে।
আর না হলে আমি বলি কি কৃষক বাচলে বাচবে দেশ শহরের ইট পাথরের চার দেয়ালে সব শেষ।
পরিশেষে বর্তমান সরকার জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশেষ অনুরোধ থাকবে
আর যেন কৃষক রাস্তায় প্রতিবাদে না নামে।আর যেন কৃষক না বলে যে, ‘আর করবোনা ধান চাষ,দেখবো তোরা কি খাস’।আমরা মাছে ভাতে বাঙ্গালি, আমাদের খাদ্যের মূল উৎপাদন হচ্ছে কৃষি।আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ, তাই এই কৃষিকে ধরে রাখতে হলে তাদের উৎপাদিত পন্যের সঠিক মূল্য দিয়ে কৃষক বাচান।
কৃষক বাচলে বাঁচবে দেশ, কৃষক বাচান, দেশ বাচান, আমাদের বাচান।
লেখকঃ
এস এম মিজানুর রহমান মামুন
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
