‘পেপার লেস মার্কেট’ তৈরি করেছেন অসাধু পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা

পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ও দেশিয় বাজারে পাইকারী বিক্রয়মূল্য গোপন করতে অভিনব কৌশল নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এজন্য তারা পাইকারি বাজারে ‘পেপার লেস মার্কেট’ তৈরি করেছেন। আমদানিকৃত পেঁয়াজ কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ সেই তথ্যটিও গোপন রাখছেন তারা। ভুয়া ঠিকানা দিয়ে তৈরি করছে রসিদ।
মার্কেটে ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো তথ্য প্রমাণ রাখছেন না এসব ব্যবসায়ীরা। শুধু মুখের কথায় আমদানিকারকরা বিক্রির দাম ঠিক করে দিচ্ছে পাইকার বা কমিশন এজেন্টদের। বেচাকেনার কোনো কাগজ না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। সমকাল’র এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
পেঁয়াজের দাম নিয়ে এমন কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। এরপর পেপার লেস মার্কেটের হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। এরই অংশ হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার দুই পেঁয়াজ আমদানিকারককে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন। আজকালের মধ্যে এ অভিযান আরো জোরালো হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত ও প্রশাসনকে ফাঁকি দিতে কাগজপত্রবিহীন মার্কেট তৈরি করেছে পেঁয়াজ কারসাজির সিন্ডিকেট। আমদানিকৃত পেঁয়াজের মজুদ তথ্যও গোপন করার সুযোগ নেয়া হচ্ছে এ প্রক্রিয়ায়। কোন পেঁয়াজ কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে সেই তথ্যটি গোপন রাখা গেলে মজুদ সম্পর্কেও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে পারবে চক্র। গোয়েন্দা সংস্থা তাদের সবাইকে চিহ্নিত করেছে। পেঁয়াজের বাজার নিয়ে যারা কারসাজি করছে তাদের যাবতীয় তথ্যও প্রশাসনের কাছে এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে নির্দেশনা এসেছে। তবে কৌশলগত কারণে এ সিন্ডিকেটের হোতাদের নাম প্রকাশ করছে না প্রশাসন।
গোয়েন্দা সূত্র মতে, পেপার লেস মার্কেট তৈরির কারসাজিতে আছে ২০ থেকে ৩০ ব্যবসায়ী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও কক্সবাজারের এ ব্যবসায়ীরা প্রথমে কারসাজি করছে আমদানিমূল্য নিয়ে। দেশে পেঁয়াজ আসার পর এগুলো কোথায় রাখা হচ্ছে, কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে, কত টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে- গুরুত্বপূর্ণ এ তিনটি তথ্যও গোপন করছে তারা। এজন্য পাইকারি মোকাম ও কমিশন এজেন্টদের কাছে মুখে মুখে পণ্য বিক্রি করছে তারা। যারা তাদের কাছে বিশ্বস্ত শুধু তাদেরই এভাবে মুখে মুখে দাম ঠিক করে পণ্য সরবরাহ করছে এ সিন্ডিকেট। বিপদ এড়াতে কেউ কেউ আমদানি ও বিক্রয়মূল্যের বিকল্প আরেকটি রসিদ তৈরি করছে। মিয়ানমার থেকে আনা পেঁয়াজের প্রকৃত আমদানিমূল্য ৩৫ থেকে ৪২ টাকার মধ্যে হলেও বিকল্প এ রসিদে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় কেনা দেখানো হচ্ছে। আবার বিক্রয়মূল্য দেখানো হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা।
চট্টগ্রামের পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জ ও রেয়াজউদ্দিন বাজারে যুগপৎ অভিযান চালিয়ে পেপার লেস মার্কেটের প্রমাণ পায় জেলা প্রশাসন। খাতুনগঞ্জের পাইকারি মোকামে অভিযান চালিয়ে রেয়াজউদ্দিন বাজারের তিনটি রসিদ পান তারা।
এসব রসিদে পেঁয়াজ সরবরাহকারী হিসেবে ঠিকানা উল্লেখ ছিল- এ হোসেন ব্রাদার্স, ১২৯/১৮, খাজা দস্তগীর ম্যানশন, নিচতলা, গোসাইল কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম। জে এস ট্রেডার্স, ১২৯/৪, শেখ জানে আলম ম্যানশন, গোসাইল কোয়ার্টার। মেসার্স সৌরভ এন্টারপ্রাইজ, নূপুর মার্কেট, ৮৬, স্টেশন রোড, চট্টগ্রাম। কিন্তু এ তিনটি ঠিকানায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় সৌরভ এন্টারপ্রাইজ আসলে একটি জুতার দোকান। অপর দুটি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করছে বার্মিজ প্রসাধনী। প্রশাসনের চোখে ধুলো দিতেই এভাবে বার্মিজ প্রসাধনীর পসরা রেখেছে তারা দোকানে। জিজ্ঞাসাবাদে অবশ্য মুখে মুখে দর নির্ধারণ করে পেঁয়াজ বেচাকেনার কথা স্বীকার করে তারা। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাৎক্ষণিকভাবে দুই আমদানিকারককে ১৫ দিনের কারাদণ্ডাদেশ দেন।
খাতুনগঞ্জে আবারও আমদানি করা পেঁয়াজে ক্রয় মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে বিক্রির প্রমাণ পেয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ৬ নভেম্বর, বুধবার দুপুরে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে অভিযান চালান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম। এ সময় তিনি মিসর ও চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করার হাতেনাতে প্রমাণ পান।
তৌহিদুল ইসলাম জানান, খাতুনগঞ্জের মাহিন এন্টারপ্রাইজে গিয়ে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করার সময় হাতেনাতে ধরা হয়। পেঁয়াজ আমদানির কোনো কাগজপত্রও দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এমন অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা বড় চালানগুলোও কয়েক দিনের মধ্যে দেশে ঢুকবে। তাই আশা করছি, কয়েক দিনের মধ্যে দাম কমে আসবে।
