কবি সাজ্জাদুল বারী’র কবিতা “রোজনামচা”

রোজনামচা
—সাজ্জাদুল বারী
বছর দশেক পর সেদিন শর্মীর সঙ্গে শাহবাগে দেখা
তুমি নাকি জানতে চেয়েছো অ—নে—ক কিছু।
বলেছো এখন দিনগুলো কীভাবে কাটাই তা যেন
অবশ্যই সবিস্তারে, ডাক বিভাগের মাধ্যমে জানাই।
কতদিন তোমাকে লিখেছি; কিন্তু ডাকে ফেলা হয়নি,
পরিবর্তে সেগুলো সমাধি দিয়েছি লেপ তোষকের নিচে।
সেখানেই তারা প্রতিনিয়ত হা- হুতশ করে মরেছে।
আমি গাঁও-গেরামের ছেলে, তোমাদের ভাষায় খ্যাত।
বলতে পার দেশি গরুর খাঁটি দুধ; যে পাত্রে রাখবে
সাবান সোডা দিয়ে ধোয়ার পরেও তা থেকে গন্ধ বেরবে।
খুঁজে দেখ আমার পায়ে হয়তো এখনও কাদা লেগে আছে,
পলিমাটির শস্যের মত আমার শরীর বেড়ে ওঠেনি সত্যি,
তবে কাদামাটি আর সোনা রঙের পাকা ধানের গন্ধ
এখনও আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খুঁজে পাবে।
শহর সম্পর্কে কৌতূহল তো আমাদের আজীবনের;
তুমি পরিযায়ী পাখির মত গ্রামে এসে আমার মনে
যে রেখাঙ্কন করেছিলে, তা আজ দীর্ঘ হতে হতে —
এই ইট পাথরের অমানবিক শহর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
বর্তমানে আমি নিঃসন্দেহে পাকা শহুরে হলেও—
যারা বাসের ট্রেনের জানালা দিয়ে গ্রাম দেখে শিউরে ওঠে,
আমি তাদের দলে নই; আমি ঐ আগের জাতের।
হ্যাঁ, যে কথা বলতে বসেছি, শোন——
এখন লেখার ইচ্ছেও নাই আর সে যুগও এখন বাসি,
তারপরেও বন্ধু শর্মীর অনুরোধে পুরনো চিঠিগুলোর
জীবাশ্ম; সমাধি থেকে তুলে পুণরায় পোস্টমর্টেম করছি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জানালাম একটি দিনের রোজনামচা।
শোন, কোনোদিন সূর্যোদয় দেখি কোনোদিন দেখি না।
দাঁতব্রাস,শেভ,প্রাতঃক্রিয়া শেষ করে নাস্তার টেবিলে বসে
দুই কামড় টোস্ট, অর্ধেক কলা, তারপর ব্লাক কফি।
কোনোদিন লেখার টেবিলে বসি কোনোদিন বসি না।
আটটা দশে পুরণো গামছা কাঁধে নিয়ে ঢুকি বাথরুমে
ঠাণ্ডা জলে সিকিঘণ্টা ধরে চৌবাচ্চা খালি করে স্নান।
উর্দিপরে নয়টা পনেরোতে যাত্রা করি।উদ্দেশ্য ক্যাম্পাস
সারাদিন একটানা ক্লাসের পর ক্লাস।বিকেলে ফিরি।
হাপুস হুপুস করে খাই।ঘরের টুকিটাকি কাজ করি।
সন্ধ্যায় যাই থিয়েটারে।খগেনের চা আর জম্পেশ আড্ডা।
আড্ডা চলে একটানা, রাত আটটা অবধি। তারপর—
আড্ডা ভেঙ্গে আটটা ত্রিশে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি।
হাতমুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে রাত এগারোটা কুড়ি পর্যন্ত
তারপর আবোল তাবোল দিয়ে চলে ভরপেট ভুরিভোজ
এরপর— আমার সে—ই পরিচিত তীর্থস্হান, বিছানা।
যার সঙ্গে দুই প্রহর আলিঙ্গন করে আমার ক্লান্ত শরীর।
সূর্যের মত সারাদিন পরিশ্রমে এখন স্বপ্ন ছাড়াই ঘুমাই।
তবে ঘুমসাগরে ডুবতে যাওয়ার আগে যাই সে—ই অতীতে।
স্পষ্টই দেখতে পাই হইহুল্লোড় করে গঙ্গা যমুনা খেলছি,
সেই রোদেলা বিকেলের রঙিন মুখগুলো আজ বড্ড পীড়া দেয়।
আজও মনে আছে বরিষাদের গাছের ছোট্ট একটা শশা
ছেঁড়ার জন্য কি মার না খেয়েছিলাম মায়ের হাতে।
বাবাকে বলবো, সে সাহস ছিলো না, যদি আবার•••
এই ভয়েই কাটিয়েছি প্রায় পনেরো দিন; তবু ভয় যায়নি।
হঠাৎ মনে পড়লো, সেদিন বউ-শাশুড়ি খেলায়
উজ্জ্বলের বউ হয়েছিল হাছনা।জোর করে নবনীকে
শ্যালিকা বানিয়েছিল পলাশ, আজাদ, বাদল।
বিয়ের গান গেয়েছিল সেঁজুতি আর কবি—-
পায়ের নূপুর বাজিস না তোর পায়ে পরি রে••••
হাতের ঘড়ি থামিস না তোর হাতে ধরি রে••••
পায়ের জুতা ছিঁড়িস না তোর পায়ে পরি রে•••
হাতের চুড়ি ভাঙিস না তোর হাতে ধরি রে।
আজও আমার হাসি পায় সে বিকেলের ঘটনায়।
কলাপাতার ঘরে ওদের দাম্পত্যজীবন শুরু হয়েছিল,
বেনারশীর পরিবর্তে কলাগাছের ফিতে, নোলকের পরিবর্তে ওরকলমি ফুল, বরের হাতের ঘড়ি হয়েছিল
নারকেল গাছের পাতা দিয়ে।বনভাটের পাতায় মাটির
পোলাও কোরমা নিয়ে কি হইচই না করেছিল সবাই।
আমাকে মাংস দাও,আমাকে মিষ্টি দাও••• দই খাব না
ইত্যাদি •••• ••• ইত্যাদি ••• •••• •••••।
খাওয়া শেষে নবনী যখন বলেছিল উঃ উঃ কি ঝাল,
মুখ জ্বলে যাচ্ছে,আমি পানি খাব,আমাকে পানি দাও।
পানি আনতে ব্যস্ত হয়ে সবাই বাড়ির দিকে ছুটেছিল হাসতে হাসতে।
সেদিনের বিকেলের মত আর একটি বিকেল আমায়
কেউ কখনো ফিরে দেয়নি; ফিরে দিলও না।
আমি এই ফ্যাকাশে ভিখারী বিকেল কখনো চাইনি।
আজ এতগুলো বসন্ত পার হয়ে সূর্য এখন মধ্য গগনে
কখন আলাদা হয়ে গেছে পুরণো সেই সাথীদের পথ
কে কোথায় কার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে আছে জানিনা।
জীবনের মধ্যাহ্নে এসে আজ যখন সে—ই বিকেলে
উজ্জ্বল আর হাছনার কলাপাতা ঘরের দাম্পত্য নিয়ে ভাবি
সত্যিই আনন্দে আপ্লুত হয়ে দুচোখ ভরে জল আসে,
একসময় ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে চুপসে যায় বালিশ ।
কখন ঘুম সাগরে নিমজ্জিত হই জানি না।
যখন জানতে পাই দেখি,পূর্বপাশের জানালার রেলিং দিয়ে
হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে সকালের সোনালি রোদ।
তারপর সে—ই সকাল, সে—ই সকাল সে—ই সকাল।
