9:52 PM, 12 November, 2025

ঘরে ঘরে অযোগ্যতার গল্প, খারাপ ব্যবহারই তার পথ্য

inbound7250408286955588255

“কেউ আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে?”

একটু ভেবে দেখুন তো কেন! এমন কি করেছেন বা এমন কি হয়েছে যার জন্য সে আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে! আপনার কোন দোষ বা ভুলের জন্য এমন করছে, নাকি নিজের কোন স্বার্থ সিদ্ধ হলো না দেখে এমন করছে, নাকি কোন অযাচিত বিষয় নিয়ে অন্যায় ভাবে করছে!

মোটকথা, ভেবে দেখুন তো তার ব্যবহারটা কতটা সঠিক বা ন্যায়সঙ্গত। তারপরে না হয় বিচার করবেন সে খারাপ করলো নাকি ভাল।

ছোট থেকেই বহু মানুষকে দেখতাম আমার সাথে নিতান্তই বিনা কারনে খারাপ ব্যবহার করতে। আমি বরাবরই এর লজিক্যাল কোন কারন খুঁজে পেতাম না। কারন আমি সবার সাথেই স্বাভাবিক আচরন করতাম, ভাল ব্যবহার করতাম, যখন যার যে সাহায্য লাগতো করতাম। কখনও আমার সাথে অন্যায় করা মানুষটাকেও সাহায্য করা থেকে বিরত থাকতাম না। যখন চাইতো নিজের করা সাজেশন, নোটস সব দিয়ে দিতাম।

ছোট থাকতেই একবার আমাদের ক্লাসের থার্ড বয়কে সবার সামনেই বলতে শুনলাম, আমি অনেক মোটা। এই জন্য সে আমাকে পছন্দ করে না। ভাল লাগে না দেখে খারাপ আচরন করে। সেদিন বুঝলাম, মোটা বা অসুন্দর হলেও লোকে খারাপ আচরন করে। এটাও স্বাভাবিক।

বড় হতে হতে তাদের এই খারাপ আচরনের কারনটা লজিক্যাল লাগতো না। তাই সাপোর্ট করতে পারতাম না। এই জন্য এমন সবার কাছ থেকেই আমি দূরে থাকার চেষ্টা করতাম যাদের কাছে চেহারা বা বাহ্যিকতা বেশি মূল্য রাখে। এমন কাউকে বিয়ে করা তো দূরের কথা, কল্পনাও করতে পারতাম না যে এমন কাউকে বিয়ে করতে হবে।

মোটামুটি এই ইলজিক্যাল কারনে মানুষের খারাপ আচরন এক সময় নিজের অপমান মনে হতো। কেউ যেচে নিজের অপমান করতে চায় না। আমিও চাইতাম না। কেউ ভদ্র ভাবে সাহায্য চাইলে কোন স্বার্থ ছাড়াই করতাম। তারপর তারা যা মন চায় করুক। দূর হয়ে যেতাম।

এমনই একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। আমার বিয়ের সময় আমাদের বাড়ি, টাকা এসব দেখে আমার এত এত ত্রুটি, মোটা হওয়া, ল্যাংড়ায় চলা ইত্যাদি দেখেও কেউ দেখলো না। অথচ একদিন আমার বাচ্চার ডায়াপার নিয়ে খোটা দিয়ে যা না তা বলে মেসেজ করলো। আমার বাচ্চার ডায়াপার ওর বাবা দিবে না তো কি মানুষে এনে কিনে দিবে? আমাকে বলতে লাগলো, আমি আয়নায় নিজেকে দেখছি কি না, দেখতে গাব গাছের পেতনী ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার আমার প্রশ্ন, তার এমন ব্যবহার কি আসলেই যৌক্তিক ছিল?

এমন কি তাদের বাসায় যে কয়দিন থাকার সুযোগ হয়েছে, কিছুর থেকে কিছু হলে, আমার রান্না খাবে না, কিছু দিলে নিবে না, নিজের বাচ্চা শুধু না, ভাসুরের বাচ্চাকে পর্যন্ত শিখায় দেয় আমি কিছু রাঁধলে খেতে না, কিছু দিলে নিতে না, আমার ঘরে যেতে না, আমার বিছানায় বসতে না। নিজেও আমাদের বাথরুমে গিয়ে ওয়াশিং মেশিন ছাড়তে যায় আমাকে দেখে মুখে কাপড় চেপে, আমাকে তার ঘরে বা তার জিনিস ধরতে বা গুছাতে বা পরিষ্কার করতে না, আমার কাপড়ের সাথে তার ওদের কারো কাপড় মেশিনে দিতে না, আমি ও আমার বেবি বাদে সে সবার জন্য রাঁধবে ভাল হোক বা খারাপ। আমাদেরটা যেন আমরা রেঁধে খাই।

আমারই স্বামীর সংসারে আমারই ননদ আমাকে একঘরে করে রাখার সাহস পাচ্ছে তার ভাইদের আস্কারা পেয়ে। আমি ভাবছি, পরের বাসায় একঘরে হয়ে বেঁচে থাকার থেকে ভাল নয় কি নিজের একলা ঘরে একঘরে হয়ে থাকা?

একটু ভেবে দেখুন তো, আমারই স্বামীর বাসা সেটা, সংসারটাও আমার হবার কথা, ওই বাসায় থাকা একমাত্র বউ আমি। অথচ সেখানেই আমার ননদ দিনের পর দিন এসব করার সাহস পায়, এমন ব্যবহার করার সাহস পায়। আমাকে তার এত ঘেন্না লাগে যে বাচ্চারা আমার সাথে সাথে থেকে আমার ঘর ছারতে চায় না দেখে চোখ রাঙিয়ে আলাদা করে। বাচ্চাদের মনে তো এত ময়লা নাই। এসবের কি আসলেই কোন লজিক্যাল কারন থাকতে পারে?

আমার ভাই সোজাসাপ্টা ভাবনা, কেউ আমার জন্য ভাল কিছু করলে, টাকা খরচ করতে না পারলেও কোন কাজ করে দিলে, সাহায্য করলে, রান্না করে দিলে মন থেকেই একটা কৃতজ্ঞতা ভাব চলে আসে। এমন ব্যবহার করার কথা কল্পনাও করতে পারি না। উল্টা ভাবতে থাকি যে তাদের জন্য কি করবো, কি দিবো, কিছু করতে পারবো কি!

আমার মনেও হয় যে, অন্যরাও এমনই হয়তো হবে বা ভাববে। তাই আমি চেষ্টা করি, কেউ আমাকে কিছু দিলে বা আমার জন্য কিছু করলে আমিও তার জন্য কিছু করে দেয়া বা রেঁধে দেয়া বা সাহায্য করার।

বরাবরই মনে হয়, খারাপ ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হলে মানা যায়। অন্যায় ভাবে অন্যায় আচরন মানা যায় না। আমি যদি কিছু খারাপ কাজ করি, খারাপ আচরনের হকদার আমি। আমি ঘৃন্য কিছু করলাম না, আর আমাকে ঘেন্না করা হবে, আবার এটাও আশা করা হবে যে, সেই ঘেন্না নিয়ে সেই ঘৃন্য পরিবেশেই আমি পচে মরবো, কিন্তু টু শব্দ করবো না। বিষয়টা কি একটু বেশি বেশি হলো না?

কথাগুলো লিখতাম না। তবে আজ কেউ একজন আমাকে কথা শোনালো যে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, ৩ বছর পর্যন্ত আমাকে খাওয়া-পড়া না দিয়ে, ভরনপোষন না দিয়ে, নোংরা গালিও পর্যন্ত শুনতে হইছে, খোটাও পর্যন্ত শুনতে হইছে, দামী দামী কাপর, জিনিস দেয়ার পরেও কম দাম, খারাপ হইছে বলে নাক উচকে, বাপের বাড়ি থেকে খরচ নিয়ে চলে, দিন-রাত গ্রামের বউদের মত কামলা খেটে, বিনা চিকিৎসায়, বিনা প্রয়োজন পূরন করে, বিনা ভাল ব্যবহারে, দিনের পর দিন সহ্য করে, আগের যুগের বউদের মত স্বামী-শাশুরীর সেবা করেও আমার মত মেয়েকে নাকি অন্য কোন ছেলে হলে কত আগেই লাথি মেরে তালাক দিয়ে দিতো।

অপরাধ কি? অপরাধ অনেক। আসলেও অনেক অপরাধ। সবচেয়ে বড় অপরাধ কুৎসিত, মোটা হওয়া। চিকন ও সাদা চামরার হলে হয়তো শাশুরী-ননদ কোনদিন ঘেন্না করতো না। আরও বড় অপরাধ, যৌতুকের ঘোর বিরোধী ছিলাম। পুরা বাড়ি আসবাবপত্র দিয়ে সাজিয়ে দিতে পারলেও আমার মত ভাল কেউ হতো না। তখন আমার সংসার ঠিকই থাকতো। দিনরাত বিনা বেতনের কাজের বুয়া হয়ে নীরবে কাজ করে যেতাম না কেন, কথায় কথায় কাজের এই দোষ, ওই দোষ বললেও চুপ কেন থাকতে পারতাম না। বড় ঘরের মেয়ে হইছে তো কি হইছে, বুয়ার মত সব কাজ করতে হবে, পারতে হবে, চটপটেও হতে হবে। কেন হতে পারলাম না?

আরও বড় অপরাধ, শয্যাশায়ী শাশুরীর সার্বিক সেবার পাশাপাশি ঘর-সংসারের দেখাশোনা, রান্না- বান্না, নিজের ছোট বাচ্চা তো আছেই, সবার সব করার পরেও অসুস্থ হলে চলবে না, ডাক্তার না, ওষুধ না, প্রয়োজনীয় কোন জিনিস না, মন ভরে কখনও পেট ভরা না, তারপরেও শুনতে হবে, “আমার কারো হেল্প লাগবে না।” “আমাদের মায়ের জন্যে আমরা চার ভাই-বোনই এনাফ।” এসব শুনে চুপচাপ মেনে চলতে কেন পারবো না থাকতে ওদের বাসায় একঘরে হয়ে? আমাকে কারো দরকার নাই। তবুও আমাকে সেখানে গিয়ে থাকতে হবে। পারলাম না নিজের আত্ম সম্মান বিসর্জন দিতে৷ এটাই তো সবচেয়ে বড় অপরাধ।

ভাল ব্যবহার, ভালবাসা মনকে বেঁধে রাখে। কিন্তু যেখানে রোজ, প্রতিনিয়ত হতাশ হতে হয় উঠতে, বসতে, খেতে, পড়তে, তাও কিনা সব করে, সর্বোচ্চ করেও সেখানে জানি না অন্য কেউ কতদিন টিকতে পারবে। আমার তো সম্ভব হলো না। তাই হয়তো একটা বউ এরও ওই বাসায় টেকা সম্ভব হয় নি।

অনেকেই বলেছিলেন, “এই যুগের মেয়ে হয়েও তুমি যা করেছো শাশুরীর জন্য, তা অনেক আপন মেয়ের পক্ষেও সম্ভব হয় না। আর তুমি পরের মেয়ে হয়েও করেছো।” আজ উনার কথাগুলো শুনে মনে হলো, এরপরেও হয়তো সে ই সঠিক। স্বামীর মা এর গু পরিষ্কার করেও যে মেয়ে তালাক পাবার যোগ্য হয়, সংসার না পাবার যোগ্য হয়, খারাপ ব্যবহার বা গালি পাবার যোগ্য হয়, মাইর খাবার যোগ্য হয়, মানুষ পর্যন্ত হবার যোগ্যতা রাখে না।

আমার জানা নাই, এরপর আর কি করলে সে মানুষ হবে ও সব যোগ্যতা লাভ করবে ও সব পেতে পারবে ভালবাসা, সম্মান, মর্যাদা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *