স্বাধীনতা সমাচার – মারুনা রাহী রিমি

অনেকেই মনে করেন, টাইট দিয়ে অধীনস্তদের(সন্তান বা ছাত্র- ছাত্রী বা কাজের লোক বা কর্মচারী বা বউ বা স্বামী) হাতে রাখা বা সোজা পথে চালানো বা সততার মাঝে বা ভাল রাখা সম্ভব। কিন্তু সরেজমিনে নামলে সর্বদাই প্রমান হয়, স্বাধীনতায় মানুষ সততা বেশি বহন করে ও অনুগত থাকে। তাদের সচরাচর আলাদা করে বলতে বা বোঝাতে হয় না যে, এই বিষয়টা খারাপ বা ঠিক না।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বলবো, আমাকে যদি স্বাধীনতা দেয়া হয় তখন আমি নিজে থেকেই যেটা ভাল সেটা করি। কিন্তু কেউ যদি আমাকে গরুর মত লাগাম লাগিয়ে টাইট দেয়ার চেষ্টা করে তবে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। যেমন, স্কুল-কলেজে আমাকে লদোষ করলে টিচার বা আব্বু আম্মু কিছু বললে আমি টু শব্দও করতাম না। কিন্তু যেই আমাকে বিনা দোষে কিছু বলা হতো, মারা হতো বা জোর করা হতো বা রাগ দেখানো হতো, অমনি জিদ চেপে যেতো।
কোন কোন টিচারের কাজ ছিল বিনা দোষেও মারা বা বকা দেয়া বা অপমান করা। জিদ করে পড়া পেরেও দিতাম না। দাড়িয়ে থাকতাম ও মনে মনে বলতাম, দেখি আমাকে মেরে কিভাবে টাইট দেয়।
এটা তো গেল আমার নিজের ব্যক্তি জীবনের কথা। তবে আমি প্রায়ই দেখি, হাতে রাখতে গিয়ে বেশি টাইট দিয়ে মানুষ আরও বেশি খারাপের দিকে যায়। তাই অনেকেই বলে, পাখিকে হালকা করে ধরলে উড়ে যায়, টাইট করে ধরলে মরে যায়। তাই এমন ভাবে ধরতে হবে যাতে উড়েও না, মরেও না।
সন্তানদেরও তাদের প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা দেয়া উচিত। বেশি টাইটও দেয়ার চেষ্টা করা ঠিক নয়, একেবারে ছেড়েও দেয়া ঠিক নয়। তার যতটা দরকার স্বাধীনতা দেয়া উচিত। কোন কিছুতে জোর করলে বরং হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা থাকে। যেমন, জোর করে খাওয়াতে গেলে সারাজীবন খাবারের প্রতি তার অনীহা চলে আসে। কিন্তু খাবারে তাকে স্বাধীনতা দিলে সে নিজে থেকেই ততটা খাবে যতটায় তার পেট ভরে।
অনেক মেয়েদের দেখি স্বামীদের অনেক বেশি টাইট দিয়ে রাখে। বেশি সময় বাইরে থাকা যাবে না, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া যাবে না, অফিস থেকে সাথে সাথে বাসায় ফিরতে হবে, কোন মেয়ের সাথে কথা বলা যাবে না, কোন মেয়ের দিকে তাকানো যাবে না, এখানে নিয়ে যেতে হবে, অখানে নিয়ে যেতে হবে, এটা কিনে দিতে হবে, ওটা কিনে দিতে হবে, সিগারেট খাওয়া যাবে না, মদ খাওয়া যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বেশি টাইট দেয়া মেয়েদের স্বামীরাই বেশি খামখেয়ালী হয়। নানা বাহানায় বাইরেই থাকা পছন্দ করে, বেশি বেশি মিথ্যা বলে বউ দের, বেশী পরকীয়া করে, বেশি বেশি বউকে ফাঁকি দেয়, বউ দের থেকে অন্য মেয়েদের প্রতি আরও বেশি আগ্রহ থাকে ইত্যাদি।
ঠিক টাইট দেয়া বাড়ির বউরাও উপরে উপরে দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে ঝামেলা করে। উল্টো সেই বউ দের জিদ চেপে যায়। পিছনে লেগে থেকে বউদের বুয়ার মত কাজ করাতে গিয়ে উল্টো খারাপ হয়। কাজে দেরি, রান্নায় গাফিলতি ইত্যাদি। এমন গল্পও শুনেছি যে এমন টাইট দেয়া কোন কোন বউ রাগ করে খাবারে থু থু দিয়ে দেয়, অন্য কোন ভাবে সায়েস্তা করে ছাড়ে। কিন্তু সবই করে লুকিয়ে লুকিয়ে।
অনেক স্বামীদেরও দেখি স্ত্রীকে অনেক চাপে রাখে, টাইট দিয়ে রাখে। এটা করবা না, ওটা করবা না, এটা কেন হল, ওটা কেন হল, এটা কেন করলা, ওটা কেন করলা, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, বাপের বাড়ী যাবা না, কোন ছেলের সাথে কথা বলবা না, তোমার কাজিন ভাইদের থেকেও দূরে থাকবা, ইনটারনেট ব্যবহার করতে পারবা না, কারো সাথে চ্যাট করতে পারবা না, অনলাইন থাকতে পারবা না ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ নিজেদের কিন্তু সব স্বাধীনতা থাকবে।
রাতের বেলা নিজেরা অনলাইন থাকলে, পরকীয়া করলে, অন্য মেয়েদের সাথে চ্যাট বা কথা বললে কিছু না। বউ কে শুধু অনলাইন দেখলেই পরকীয়ার অপবাদ দিয়ে দেয়। এমন লোকদের বউরাও প্রায়ই ত্যারা পথ নিয়ে নেয় যদিও বহু নারীরা এসব সহ্য করে যায় দিনের পর দিন।
অন্য সবার কথা জানি না। আমাকে অন্তত টাইট দিয়ে কোনদিন কোন কাজ করানো যাবে না। চেষ্টা করলে হয় করবোই না সেই কাজ বা শুনবোই না সেই কথা। নয়তো হিতে বিপরীত হবে। কিন্তু আমাকে স্বাধীনতা দিয়ে দিলে দুনিয়ার সবচেয়ে honest ও সত্যবাদী সহজ মানুষ হয়ে সোজা পথে থাকি ও বেশ ভাল থাকি। কিন্তু যেই কেউ টাইট দিতে যায়, ওমনি যেন দুনিয়ার সবচেয় ত্যারা ও জিদ্দি মানুষ হয়ে যাই। আমাকে তখন মেরে ফেললেও লাভ হবে না। সেই কাজ আমি কোনদিনও করবো না বা সেই কথা কোনদিনও মানবো না। সীমা ছাড়িয়ে হিতে বিপরীত হয়তো বা করি না। কিন্তু জিদের চোটে তারা যা করাতে চাইবে সেটাও করি না।
আমি নিজেও কাউকে টাইট দিয়ে রাখার পক্ষপাতি নই। স্বামীর বেলায়ও আমি তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে থাকতে দিয়েছি, চলতে দিয়েছি। সে সম্পুর্ণ ম্যাচিউর। ভাল খারাপ জ্ঞান তার আছে। সে নিজে যদি নিজের ভাল-খারাপ, সঠিক-বেঠিক না বোঝে তখন ঝগড়া করে, জিদ করে, রাগ দেখিয়ে, টাইট দিয়ে সম্ভব নয়। তাই তাকে সম্পুর্ন ছেড়ে দেই তবে ভাল ও সঠিক বিষয়টা জানিয়ে। আজও তাই আমি তাকে মুক্ত করে দিয়েছি। সে যেমন থাকতে চায়, যার কাছে থাকতে চায় থাকছে। দুনিয়ার সব আমার ও আমার বাচ্চা থেকেও মূল্যবান তার জন্য। তবুও কিছু বলি নি। শুধু পূর্বাভাস দিয়েছি যে, একদিন বুঝবে। যাদের ও যে জিনিসগুলো বউ বাচ্চা থেকেও মূল্যবান ভাবছো একদিন সেগুলোই দেখিয়ে দেবে তুমি কত বোকা ছিলে। সোনার দাঁত লাগাবে বলে আসল দাঁত ই ফেলে দিলে।
আমি আমার সন্তানকেও জোর করে কিছু করাতে চাই না। আমি পথ দেখিয়ে দিবো, শিক্ষা দিবো। তারপর স্বাধীনতা। বাকিটা আল্লাহ ভরসায় ছেড়ে দিবো। আমার বিশ্বাস আল্লাহ তাকে সব সময় সঠিক পথেই নিয়ে যাবেন। যা ভাল হবে সেটাই করবেন।
তাই তো এখন থেকেই চেষ্টা করি। ঘুমাতে চাইলে ঘুমায়, খেলতে চাইলে খেলতে দেই, যতটা নিজে থেকে খায় ততটাই খাওয়াই। অন্য বাবা-মায়েদের মত খাবার নিয়ে পিছে লেগে থাকি না। আমি চাই, আমি চেষ্টা করবো ওকে ডিসিপ্লিনের মাঝে রাখতে। কিন্তু জোর করে নয়। তাই আমার বেবি মাশাল্লাহ নিজেই ডিসিপ্লিন মেইন টেইন করে। অনেকে বলে আমি জোর করে অভ্যাস করেছি। আসলে কিন্তু সেটা সঠিক নয়। আমি রাতে ঘুমের জন্য সময়মত পরিবেশ সৃষ্টি করে চেষ্টা করি। সে৷ ছোট থেকেই রাতে সময়মত ঘুমিয়ে সকালে উঠার অভ্যাস করেছে। খাওয়ার ক্ষেত্রেও, যেটা তার ভাল লাগবে না, মুখ ফিরিয়েও দেখবে না, মুখে নেয়া দূরের কথা। ভাল লাগলে সে নিজেই আগ্রহ নিয়ে খেতে আসবে, হা করবে। পানি, দুধ বিছানায় থাকে। যখন লাগে নিজেরটা নিজেই নিয়ে খাবে। কখনও ঘুম থেকে উঠে খেতে খেতে ঘুমিয়েও যায়।
এসব অভ্যাস করানো কি কারো সম্ভব! সে নিজেই সব করে আল্লাহর রহমতে।
তাই আমার মনে হয় বাচ্চা বয়স থেকে সন্তানদের ভাল-খারাপ, সঠিক-বেঠিক শিক্ষা দিয়ে, বুঝিয়ে তাদেরও একটা স্বাধীনতা দেয়া উচিত খাওয়া, ঘুম, খেলা, পড়ালেখায়। যতটা প্রয়োজন তারা নিজেরাই নিয়ে নিবে। বাকিটা একটু সাহায্য করলেই হল। তবে জোর করে বা টাইট দিয়ে নয়।
