9:54 PM, 12 November, 2025

জীবন আমাকে শিখিয়েছে – মারুনা রাহী রিমি

inbound1054204701881772440

জীবন আমাকে পদে পদে অনেক শিখিয়েছে। জীবনের কাছে আমি তাই অনেক কৃতজ্ঞ। তাই আমি সব সময় নিজেকে আর অন্যকেও এই একটাই কথা বলতাম উপদেশ স্বরূপ, “একটু সময় দাও। একদিন নিজেই বুঝবে কেন বলেছিলাম।“

জীবন আমাকে শিখিয়েছে, সময়ের থেকে বড় মলম আর হয় না। সময় একসময় সব সহনশীল করে দেয়। জীবনের চড়াই-উৎরাই হয়তো কখনও কখনও আমাদের হারিয়ে দেয়। কোন ভাবে এই হেরে যাওয়ার সাথে যুদ্ধ করে যদি কিছুটা সময় পার করে দেয়া যায়, তখন মেলে আসল শিক্ষা। হেরে গেলেও সেই হার আমাদের সহ্য হয়ে যায়।

ক্ষত সে যত বড়ই হোক না কেন, একসময় শুকিয়েই যায়। হয়তো দাগ থেকে যায় বা পঙ্গু করে দিয়ে যায়, কিন্তু কখনও না কখনও ঠিকই সয়ে যায়। শুধু মনের মাঝে সেই দাগ রেখে যায় যা দেখে মনে পড়ে যায় সেই ব্যাথা পাবার মুহূর্তটুকু।

আমিও এই বিষয়টা খুব করে বিশ্বাস করি। ব্যাথা কাঁচা থাকা অবস্থায় যতই কষ্ট হোক না কেন সময় সেটা ভুলিয়ে দেয়। নইলে হয়তো মায়েরা কখনও একবার সন্তান জন্মের ব্যাথার কথা কোনদিন ভুলতে পারতো না। সেই ব্যাথার কথা মনে করে পুনরায় মা হতেও চাইতো না। একাধিকবার মা হবার অভিজ্ঞতাও এর একটা বিশাল প্রমান যে, সময়ের সাথে সব ব্যাথাই মানুষ ভুলে যায়। থেকে যায় কিছু স্মৃতি। কারন দাগটা বারবার জানান দেয় সেই সুখকর ব্যাথা বা দুঃখকর ব্যাথার সময়টা।

আমাদের মানুষের ভালবাসার হিসেবটাও এই সময়ই নির্ধারণ করে। একটা সময় সেই মানুষটার সাথে দেখা, কথা, সময় কাটানো থেকে শুরু হয়ে স্বপ্ন সাজানো। কখনও কখনও সেই মানুষটাই হয়ে উঠে আমাদের দুনিয়া। তাকে ঘিরেই যত সপ্ন, জল্পনা-কল্পনা। এক সময় আমরা একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই যাকে ভালবাসা বলে নাম দেয়া হয়। প্রথম সময়টা হয়তো ভালবাসায় পরিণত হয় না। কিন্তু একসময় এই ঘোরই হয়ে উঠে আমাদের ভালবাসা।

ঘোরের মধ্যে থেকে কোন ব্যাথা পেলে খুব সহজে না হলেও ব্যাথাটি তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায়। কিন্তু ভালবাসার ব্যাথা ক্যান্সারের মতো মারাত্মক। এটা শুধুমাত্র সেই সকল মানুষই অনুভব করতে পারবে যারা জীবনে ১ বার হলেও সত্যিকার অর্থে ভালবেসেছে।

তবে ওই যে বললাম, সময়ই হয়ে উঠে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা। ভালবাসায় পাওয়া সেই ক্যান্সারও আমাদের সহ্য হয়ে যায়। মনের ব্যাথা হয়তো থেকে যায়, কিন্তু একসময় সেটাও সহনশীল হয়ে যায়।

ভালবাসার এই ব্যাথাটা ম্যক্সিমাম ক্ষেত্রে কেন যেন মেয়েদের জীবনটা উথাল-পাথাল করে দিয়ে যায়। খুব কম পুরুষকে দেখেছি ভালবাসার এই ব্যাথায় হেরে যেতে। কোন না কোন ভাবে তার জীবনটা আবারও সেজেই উঠে নতুন ভাবে, নতুন রঙ্গে। প্রেমের ক্ষেত্রে নতুন প্রেম নিয়ে আসে জীবনের নতুন সকাল। বিয়ের ক্ষেত্রে নিয়ে আসে নতুন কোন বউয়ের সাথে নতুন কোন জীবন। পুরনো সব সময় পুরাতন কাপড়ের মতই একটা ফেলনা ত্যানা হয়ে রয়ে যায়।

আমার মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে যে, আমরা মেয়েরাই কেন কাপড়ের মতো ক্ষণস্থায়ী কিছু জিনিস হয়ে রই? আমাদের কি জীবন বা মন নাই? কেন পছন্দের কাপড় হলে একটু বেশিদিন ব্যবহার করে পুরুষ পুরাতন বা নষ্ট হয়ে যাবার পরেও! আর অপছন্দের হলে সামান্য একটু পুরাতন হলেই পড়ে যায় বাতিলের খাতায়।

এটাও আমাকে খুব কষ্ট দেয় যে, আমরা মেয়েরাই কেন একটা পুরুষের জন্য পর্যাপ্ত হতে পারি না? কেন একটা পুরুষ মাত্র কিছুদিনেই তার প্রেমিকা বা বউ এর প্রতি বোর হয়ে যায়? কেন একটা মেয়ে একটা পুরুষকে স্থায়ী ভাবে ধরে রাখতে পারে না নিজের হৃদয়, মন-প্রাণ দিয়েও। একসময় মেয়েটা বোরিং একটা খাবার বা জিনিসের পর্যায়ে পড়ে যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে তো এমনটা হয় না। মেয়েরা তো সময়ের সাথেই ভালবাসতে শিখে আর সময়ের সাথে সেই ভালবাসা, মায়া, মমতা বাড়তে থাকে। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে কেন এমন হয়?

আমি সেই সব ছেলেদের স্যালুট করি যারা তাদের বউদের প্রতি বোর হয়ে যায় না একটা সময় পর। অনেক প্রেমের পরেও বিয়ে সেই প্রেমিকাকেই করে। এরেঞ্জ ম্যারেজেও সেই মেয়েটিকে নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয় তা মেয়েটা পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী বা বিছানায় পড়া কোন অসুস্থ রোগীই হোক না কেন। সেই সকল পুরুষদের স্যালুট করি যারা জানেন তাদের স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে মরে যাবেন, স্ত্রী বারবার বলার পরেও অন্য কোন মেয়েকে জীবনসঙ্গী করার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। সত্যিকারের ভালবাসা হয়তো একেই বলে। যদিও এই ভাগ্য সব মেয়ের জুটে না।

সময়ের সাথে অপেক্ষার প্রহর গোনাও ধীরে ধীরে কমে যায়। একটা সময় পর্যন্ত আমরা খুব করে অপেক্ষা করি এই ভেবে যে, আমাদের মনের ভালবাসা একসময় তাকে টেনে নিয়ে আসবে। ফোন আসবে, বা ম্যাসেজ আসবে বা সে নিজে আসবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা এটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে, আমাদের মন থেকে আসা সেই ভালবাসার কোন শক্তিই ছিল না কোনদিন। আমাদের মন হেরে গেছে বাহ্যিকতার কাছে, ভাগ্যের কাছে।

সময়ের সাথে সাথে সেই অপেক্ষাও হারিয়ে যায় মানুষের। সহনশীল হয়ে যায় মানুষ। দুরুত্ব একসময় হয়তো আমাদের সম্পর্কও ভুলিয়ে দেয়। এটাই হয়তো আমাদের জীবনের জন্য ভাল। কারন ভাগ্যের থেকে আমরা না বেশি পেতে পারি আর না কম। পুরুষ ঠিকই এগিয়ে যায় মেয়েদের ত্যাগের উপর নিজেদের রাজপ্রাসাদ বানিয়ে। এক সময় সেই ত্যাগের উপরেই নতুন নতুন রানীর আগমন ঘটে।

সবাই ভাবতে শুরু করে, “ইস! মেয়েটা কি বোকা ! এভাবে কেউ ত্যাগ করে? নিজের হক কেউ এভাবে ত্যাগ করে!” অথচ এই ত্যাগের মহিমাতেই টিকে আছে এই পৃথিবী। স্বামীর জন্য স্ত্রীর ত্যাগ, সন্তানের জন্য মায়ের ত্যাগ, ভাইয়ের জন্য বোনের ত্যাগ, অন্য সবার জন্য মেয়েদের ত্যাগ। এই ত্যাগ না থাকলে কবেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো। হেরে যেতো ভালবাসা।

আমার ত্যাগের জন্য, অধিকার ছেড়ে দেয়ার জন্য, মানুষকে মুক্ত করার জন্য বরাবরই আমাকেই ভরপাই করতে হয়েছে, হারতে হয়েছে, কষ্ট পেতে হয়েছে, মানুষের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি কখনও ভ্রূক্ষেপ করি নি। হেরে গিয়েও আমি জিতেই গেছি। হ্যাঁ! আমি খুব বোকা। মানুষের হিসেবে আমি খুব বোকা, আইনের হিসেবে আমি খুব বোকা, ধর্মের হিসেবে আমি খুব বোকা। কিন্তু এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে আমার বিশ্বাস, একদিন আমার এই বোকামিই আমাকে সকল পাপ হতে মুক্তি দিবে আর সেই সকল মানুষের চালাকিই তাদের সব পুন্যের অবসান করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *