ইয়াসিন আরাফাত এর অণুগল্প “ছারপোকা “

ইয়াসিন আরাফাত
ছারপোকা
❍
ডাক্তার চেম্বারের ওয়েটিংরুমটা দেখে যে কোনো রুগির আরও অসুস্থ হয়ে যাবার কথা! আমার ক্ষেত্রে ঘটল উল্টোটি। সরকারি অব্যবস্থাপনার উপর অগাদ বিশ্বাস আমার আগে থেকেই ছিল। তাই এইসব দেখে আর আগের মতো নাক সিটকানোর অভ্যাস আমার এখন নেই। তবে একটু পরপর আমার পাশে বসা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়াচ্ছেন। পাঁচ সাত কদম হেঁটে আবারও এসে বেঞ্চে বসতে বসতে বলবেন, এইখানে মানুষ বসতে পারে?
তার অভিযোগ কেবল মাথার উপরে অবস্থান করা সিলিংফ্যানের উপর নয়। সিলিংফ্যানের নাচন কাঁদন নিয়ে তিনি আরও কিছুক্ষণ আগে সরব ছিলেন। তখন বারবার সিলিংফ্যানটার দিকে তাচ্ছিলেন এবং প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক, মুখ, গলা বারবার মুছছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার বলেছিলেন, এইটা ফ্যান না বাংলা সিনেমার নায়িকা। যত দেখছি, তত গরম হচ্ছি।
এখন অবশ্য ফ্যানের উপরে তার সেই অভিযোগগুলো নেই। বারবার রুমাল বের করে নাক, মুখ, গলা মুছবারও প্রয়োজন বোধ করছেন না। এখন তার সমস্ত রাগ ওয়েটিং রুমের কদর্যকর পরিবেশ নিয়ে।
আমার দিকে কিঞ্চিৎ ঘাড় বাঁকিয়ে বললেন, এইখানে মানুষ বাস করতে পারে! অসহ্য!
আমাকে নিরুত্তর দেখে তার মেজাজ একটু খারাপ হলো, মনে হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাই! আপনাকে কামড়াচ্ছে না?
— না।
— না! আমাকে তো কামড়াচ্ছে! ওহ! আর মিনিট দুই এখানে থাকলে আমি মরেই যাবো।
আরও কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, ভদ্রলোক কয়েকবার ডাক্তাররুমের দরজায় সিরিয়ালের নাম্বার দেখে নাম ঘোষণা করা ছেলেটার সাথে কথা বলতে। একবার তো তিনি পকেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিতে চাইলেন। ছেলেটা টাকাটা ভদ্রলোকের বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, রাখন।
নিশ্চই ভদ্রলোকের মেজাজ এখন খুব খারাপ। একজন বৃদ্ধা মহিলাকে সিরিয়াল ব্রেক করে আগে ঢুকানোর কারণে তিনি ছেলেটার দিকে ছুটে গেলেন শার্টের হাতা কাছাতে কাছাতে। কিছুক্ষণ তর্ক করে আবার আমার পাশে এসে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এইগুলা হইল দুর্নীতি! দেশটা দুর্নীতিতে ভরে গেছে। যাই একটু চা খেয়ে আসি।
চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ভদ্রলোক আবার আমার পাশে এসে বসলেন। পরক্ষণেই নাম ঘোষণা করা ছেলেটা বলে উঠল, অরুণ কুমার।
সঙ্গে সঙ্গে পাশে বসা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বুঝলেন ভাই, বুদ্ধি থাকলে ঘরজামাই থাকা লাগে না। যাই আমাকে ডাকছে।
লোকটার সিরিয়াল আমারও অনেক পরে। অথচ কী একটা বুদ্ধি।করে আগেই সাক্ষাৎকারের জন্য চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর দুজন লোক এসে আমরা যে কাঠের বেঞ্চিটায় বসা ছিলাম; সেইটাকে ডাক্তার চেম্বারে নিয়ে গেল।
প্রায় মিনিট চল্লিশ পরে আমার ডাক এলো। ডাক্তাররুমে প্রবেশ করে আমি অবাক। বিরক্ত হওয়া সেই ভদ্রলোককে ডাক্তারর পিছনে সেই বেঞ্চটায় বসিয়ে আড়মোড়া দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার মুখে সার্জারি করার কসটেপ লাগানো। ডাক্তারসাহেব বললেন, এইটা হলো ওনার চিকিৎসা! ওনার প্রথম অভিযোগ ছিল ছারপোকার কামড় উনি একদম সহ্য করতে পারেন না। তাই সেইটা ওনাকে সহ্য করাচ্ছি। অধৈর্য হওয়া— এইটাও ওনার একটা মারাত্মক রোগ। এইটার চিকিৎসাও হচ্ছে। সব রুগি দেখার পরে ওনার আবার সাক্ষাৎকার নেবো। আশা করি এত সময় নোংরা পরিবেশে থেকে ওনার অভিযোজন ক্ষমতা বাড়বে। এরপর আর বাইরে থেকে ফোন করে সিরিয়াল ব্রেক করার কথা তার মাথাতে কখনো আসবে না।
আমি ভদ্রলোকের উন্মুক্ত চোখদুটোর দিকে তাকালাম। এমন মায়াময় চোখ পৃথিবীর কোনো আর্থোপ্রোডার নেই।
